সোমবার রাত ৮টা। স্পট গাবতলী আন্ডারপাসসংলগ্ন চট্টগ্রাম বাস কাউন্টার। হানিফ পরিবহণের বাস থেকে নামলেন মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি। গাড়ির বক্স থেকে লাগেজ ও একটি ব্যাগ নিয়ে হাঁটা শুরু করেন। তখনই তাকে ঘিরে ধরে হলুদ হাতাকাটা গাউন পড়া তিন যুবক। তাদের একজন ওই ব্যক্তির উদ্দেশে বললেন, ‘৩০ টাকা দ্যান।’ কিসের টাকা জানতে চাইলে, যুবকের তাৎক্ষণিক জবাব-‘সিটি ট্যাক্স।’ যুবকদের সঙ্গে ওই ব্যক্তির উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হলো। এরপর ৩০ টাকা দিয়ে হেঁটে একটু সামনে গিয়ে সিএনজি অটোরিকশায় চেপে বসলেন তিনি।
অটোরিকশা ছাড়ার আগে তার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। জানা যায়, তেজগাঁওয়ের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ওই ব্যক্তির বাড়ি মাগুরায়। চাঁদা বিড়ম্বনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকেও তিনি ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। চাঁদাবাজদের শায়েস্তা করতে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়েই মেয়রকে ফোনও দিয়েছিলেন। কিন্তু ধরেননি। এরপর নাজেহাল হওয়ার ভয়ে চাঁদা দিয়ে আসেন।
একই সময় উত্তরাঞ্চল থেকে আসা এক দম্পত্তির কাছে কয়েকটি ব্যাগ ও কিছু মালামাল থাকায় যুবকরা দাবি করেন ৬০ টাকা। ওই দম্পত্তি তাদের অসহায়ত্বের কথা জানালে, যুবকদের হুমকি-‘বেশি কথা বললে ১৬০ টাকা দিতে হবে।’ আর কথা না বাড়িয়ে ৬০ টাকা দিয়ে দেন তারা। যুবকরা চলে যাওয়ার পর তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্ত্রী শান্তা গার্মেন্টকর্মী ও স্বামী মতিউর রহমান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। করোনা মহামারির সময় স্বামীর চাকরি চলে যায়। একজনের আয়ে চলতে না পেরে মিরপুর ২ নম্বরের ভাড়া বাসা ছেড়ে তারা গ্রামের বাড়ি নীলফামারী চলে যান। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে মনে করে নতুন করে জীবন সংগ্রামে নামতে ঢাকায় এসেই এমন অনাকাক্সিক্ষত চাঁদাবাজির কবলে পড়ে ক্ষুব্ধ তারা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন যুগান্তরকে বলেন, যানবাহনের পার্কিং চার্জ আদায়ের জন্য বাস টার্মিনালগুলো ইজারা দেওয়া হয়। কিন্তু ‘সিটি ট্যাক্স’ বলতে কিছু নেই। ‘সিটি ট্যাক্স’ নামে যাত্রীদের কাছ থেকে কোনো ধরনের টোল আদায়ের বিধানও নেই।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক যুগান্তরকে বলেন, সিটি করপোরেশনের ইজারার সুযোগের অপব্যবহার করে যাত্রীদের কাছ থেকে জোর করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এটি মারাত্মক অপরাধ হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও উদাসীন। পরিবহণ মালিক, শ্রমিক ও পুলিশের আশ্রয় প্রশ্রয়েই এই চাঁদাবাজি চলে আসছে। সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে মহাখালী বাস টার্মিনালেও উল্লিখিত চিত্র পাওয়া গেছে। সোমবার রাত ৯টা ৩৫ মিনিট। টার্মিনালে প্রবেশের মুখেই মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক যুবক। কিছুক্ষণ পর আরেক যুবক এসে মোটরসাইকেলে চেপে বসতেই সামনে এসে দাঁড়ালেন কালো লিকলিকে এক তরুণ। হাতে দুই রঙের দুটো রশিদ বই। গায়ে উত্তর সিটি করপোরেশনের লোগোযুক্ত হাতাকাটা গাউন। তাতে লেখা-‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল। ইজারাদার।’ তরুণ ১০ টাকা চাঁদা দাবি করায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন মোটরসাইকেল আরোহী যুবক। চাঁদা চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে, তরুণের জবাব-এখান থেকে যাত্রী তুললে চাঁদা দিতে হয়। এটা ‘সিটি ট্যাক্স।’ এ কথা শুনে ক্ষুব্ধ মোটরসাইকেল চালক আরোহীকে নামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনি সড়কে এসে ওঠেন দেখি ও চাঁদা নেয় কী করে।’ মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীর অগ্নিমূর্তি দেখে চেপে গেলেন চাঁদাবাজরা।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ওই তরুণের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তার নাম আলমগীর। তিনি জানান, স্থানীয় যুবলীগ নেতা মিন্টু এই চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রক। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা চাঁদা তোলার জন্য তিন শিফটে ছয়জন লোক দায়িত্ব পালন করেন। ভোর ৬টা থেকে ২টা, ২টা থেকে রাত ১০টা, রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টা। ‘প্রতি শিফটে দুজন করে চাঁদা তোলার কাজ করি। শিফট শেষে চাঁদার টাকা মিন্টু ভাইয়ের অফিসে জমা দেই। চাঁদা তোলার জন্য প্রতিদিন আমরা ৪০০ টাকা করে পাই।’ লাগেজবাহী যাত্রীদের কাছ থেকে চাঁদার হার কিভাবে নির্ধারণ করা হয়- জানতে চাইলে আলমগীর বলেন, ‘আমরা ২০ টাকা করে নেই। তবে লাগেজ ছোট বড় থাকলে টাকাও কম বেশি হয়। তবে আমি কারও সঙ্গে জুলুম করি না।’ কে কে চাঁদা তোলার কাজ করে জানতে চাইলে, আলমগীর জানান, একেক সময় একেকজন তোলে। স্থায়ী কোনো লোক নেই। সোমবার চাঁদা তোলার কাজে নিয়োজিত চারজনের নাম জানা গেছে। তারা হচ্ছে, শাহীন, নাজমুল, রাজ্জাক ও রফিক। বাকি দুজন নতুন মুখ। তাদের নাম জানেন না কেউ।
কত চাঁদা প্রতিদিন উঠে জানতে চাইলে আলমগীর জানান, প্রতিদিন একেকজন গড়ে অন্তত দুই হাজার টাকা করে চাঁদা তোলেন। এ হিসাবে দিনে ছয়জনে তোলেন ১২ হাজার টাকা। মাসে যার অঙ্ক দাঁড়ায় তিন লাখ ৬০ হাজার। এ হারে বছরে শুধু মহাখালী টার্মিনাল থেকেই তথাকথিত ‘সিটি ট্যাক্স’ বাবদ চাঁদা আদায় করা হয় ৪৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। মহাখালীর মতো গাবতলী ও সায়েদাবাদ টার্মিনালেও চলে এমন চাঁদাবাজি। ফুলবাড়িয়া এলাকায় চাঁদাবাজদের বেপরোয়া তৎপরতা আছে বলে জানা গেছে। সব টার্মিনাল মিলিয়ে হিসাব করলে বছরে এ খাতে চাঁদার অঙ্ক কয়েক কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
চাঁদার রশিদ মতে, মহাখালী বাস টার্মিনালের ইজারাদার গাজী রাইয়ান এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের ক্যাশিয়ার নূরুদ্দিন আহমেদ রাহাত যুগান্তরকে বলেন, আমরা সিটি করপোরেশনের কাছ থেক ইজারা নিয়ে টার্মিনালে পার্কিং করা যানবাহন থেকে টোল আদায় করি। কিন্তু টার্মিনালের বাইরে থেকে চাঁদা আদায়ের কোনো নিয়ম নেই। এমনকি টার্মিনালে স্বজনদের নিতে আসা প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাস থেকেও টোল নেওয়ার কথা নয়। এমন কিছু ঘটে থাকলে যারা সাব-কন্ট্রাক্ট নিয়ে যানবাহন থেকে টাকা তোলার কাজ করছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন।
সাব কন্ট্রাক্ট নিয়ে চাঁদা তুলছেন তাদের একজনের নামও রাহাত। এ সম্পর্কে মঙ্গলবার বিকালে মোবাইলে কল করা হলে রাহাত বলেন, ‘আমি শুধু যারা কাজ করেন তাদের ডেইলি হাজিরার বিষয়টি দেখভাল করি। এগুলো সম্পর্কে জানেন বড় ভাইয়েরা।’ বড় ভাই কারা জানতে চাইলে রাহাত বলেন, ‘সাচ্চু ভাই ডাক এনেছে। গাজী রাইয়ান এন্টারপ্রাইজ সাচ্চু ভাইয়ের প্রতিষ্ঠান। সাচ্চু ভাই সব বলতে পারবেন।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘সাচ্চু ভাই’-এর পুরো নাম গাজী মেজবাউল হোসেন সাচ্চু। তিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি। তার প্রতিষ্ঠান গাজী রাইয়ান এন্টারপ্রাইজই মহাখালী টার্মিনালের ইজারা মালিক। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মঙ্গলবার রাতে গাজী মেজবাউল হোসেন সাচ্চু টেলিফোনে যুুগান্তরকে বলেন, সিটি করপোরেশনের নিয়ম মেনেই টার্মিনাল থেকে টোল আদায় করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যদি কেউ নিয়মের ব্যত্যয় করে থাকে তাকে চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে কাউকে সাব কন্ট্রাক্ট দেওয়া হয়নি বলেও নিশ্চিত করেন তিনি।
গাবতলী বাস টার্মিনালে সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এই টার্মিনালের টোল আদায়ের ইজারা নিয়েছে রাফি ট্রেডার্স লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান আবার বিভিন্ন অংশ বিভিন্নজনকে সাব কন্ট্রাক্ট দিয়েছে। যারা সাব কন্ট্রাক্ট নিয়েছে তাদের লোকজন কার কাছ থেকে কিভাবে টোল আদায় করছে তা তদারকির কেউ নেই। এই সুযোগে যে যার মতো যার তার কাছ থেকে ‘সিটি ট্যাক্স’ নামে চাঁদা আদায় করছেন।
অনেক সময় চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় চাঁদাবাজদের সঙ্গে যাত্রীদের বাকবিতণ্ডাও হচ্ছে। এমনকি যাত্রীরা নাজেহালও হচ্ছে তাদের হাতে। এ কারণে সব জেনেশুনেও কেউ চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করেন না।
এ ব্যাপারে জানতে মঙ্গলবার বিকালে রাফি ট্রেডার্সের প্রধান নির্বাহী শামীম খানের মোবাইলে কল করলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, কাউকে সাব কন্ট্রাক্ট দেওয়া হয়নি। নিজস্ব লোক দিয়ে টোল আদায়ের বিষয়টি তদারকি করা হচ্ছে। মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ও যাত্রীদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তার পরও যদি কেউ এমন কাজ করে থাকে তাহলে তা খতিয়ে দেখে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিরপুর) আ স ম মাহতাব উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, কেউ চাঁদাবাজির শিকার হলে সঙ্গে সঙ্গে ৯৯৯ ফোন দেবেন। অথবা গাবতলী পুলিশ ফাঁড়িতে অভিযোগ করলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।