শতাব্দীর পরিক্রমায় পৃথিবীতে এমন মহানায়কোচিত নেতৃত্বের জন্ম হয় যিনি সমাজ, রাষ্ট্রের গন্ডি পেরিয়ে সমগ্র পৃথিবীতে হয়ে ওঠেন অনন্য। যার সংগ্রাম আর সাহস পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে অনুপ্রেরণা যোগায়। কোটি মানুষের স্বপ্নকে ধারণ করে যিনি নির্ভিকচিত্তে পথ চলেন ক্ষমতার মসনদকে পায়ে ঠেলে জনআকাঙ্খার বাস্তবায়নে। যার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সঙ্কটে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকে একটি জাতি। যার অঙ্গুলি হেলনে শাসকের ভীত কেঁপে ওঠে। শাসকের আদেশ, নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যার তর্জনীর ইশারায় চলে জনতা। যার কালজয়ী নেতৃত্বে পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে একটি জাতি, একটি রাষ্ট্রের। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাঙালি জাতির এমন কাঙ্খিত এক মহানায়কের নাম শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি বাঙালির বহু শতাব্দীর আকাঙ্খিত স্বাধীন ভূখন্ডের স্বপ্ন পূরণ করেছেন, বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটিয়েছেন পৃথিবীর মানচিত্রে। কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি ভালবেসে তাকে তাই দিয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি, ঘোষণা করেছে তাদের ‘জাতির পিতা’ হিসেবে।
১৯২০-১৯৪৮ মাত্র ২৮ বছর বয়সে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেছেন। ভাষা আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ৫৪’ র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে সফল সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। ৬৬’র ছয় দফা থেকে ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান এবং এর ধারাবাহিকতায় ৭০’র নির্বাচনে আওয়ামীলীগের বিপুল বিজয় সবই এসেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা পুরুষ টুঙ্গিপাড়ার ‘খোকা’ থেকে শেখ মুজিব এবং শেখ মুজিব থেকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠা শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরে রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া টালবাহানা করতে থাকেন। পহেলা মার্চ দুপুরে আকস্মিকভাবে ৩রা মার্চের পূর্ব নির্ধারিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন তিনি। ফুঁসে ওঠে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। প্রতিবাদে ২রা মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। ২ রা মার্চ ঢাকায় এবং ৩-৬ মার্চ সারাদেশব্যাপী অর্ধবেলা ধর্মঘটের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু।
২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন চত্ত্বরের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সসমাবেশ শেষে তৎকালীন ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক শেখ জাহিদ হোসেন এর বহনকৃত বাঁশের লাঠির মাথায় ঝুলানো বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকাটি প্রদর্শন করেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা ডাকসু ভিপি আ স ম আব্দুর রব, ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারন সম্পাদক শাজাহান সিরাজ এবং ডাকসু জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন সহ নেতৃবৃন্দ। ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে ৩ রা মার্চ সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত পল্টন ময়দানের বিশাল ছাত্র জনসভা থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন ছাত্রলীগ সাধারন সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ। এই সভা থেকেই স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ‘সর্বাধিনায়ক’ এবং ‘বাঙালি জাতির পিতা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেদিনের ঐ সভা থেকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ করা হয়। এভাবে বঙ্গবন্ধু থেকে বাঙালি ‘জাতির পিতা’ হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রধান অতিথি। প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভার ঘোষণা দেন। সে জনসভা থেকেই পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেওয়ার ইঙ্গিত দেন বঙ্গবন্ধু। ৭ ই মার্চের পূর্বে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ এবং আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাত করে স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য অনুরোধ করেন। সাধারন মানুষের ও প্রত্যাশা এবং চাপ ছিল স্বাধীনতা ঘোষণার। আবার ৬ ই মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে টেলিফোন করে চূড়ান্ত ঘোষণা না করতে অনুরোধ করেন যাতে আলোচনার পথ বন্ধ না হয়ে যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন গণমানুষের নেতা। তিনি গণমানুষের চোখের ভাষা, মনের ভাষা যেমন বুঝতেন,
তেমনি কোন পরিস্থিতিতে কি সিদ্ধান্ত নিতে হবে সেটি তার চেয়ে ভালো আর কেউ বুঝতেন না। নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের মহাসমাবেশে উপস্থিত এক মিলিয়ন মানুষের মনের ঘোষণার সাথে সুর মিলিয়ে কবিতার ছন্দে ঘোষণা করলেন তার অমর বাণী-
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এই ঘোষণার মাধ্যমে তিনি যেমন তার রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ও গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণ করলেন তেমনি কৌশলে জেনারেল ইয়াহিয়ার ‘চূড়ান্ত পন্থা’ অবলম্বন না করার অনুরোধ রাখলেন পাকিস্তানি শাসকের জন্য মানার অযোগ্য চারটি শর্তে আলোচনার দ্বার খোলা রেখে।
জেনারেল ইয়াহিয়ার জন্য চারটি শর্ত মেনে আলোচনায় বসা যেমন ছিল অপমানজনক পরাজয় বরণ করা, তেমনি আলোচনায় না বসে বঙ্গবন্ধুকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ তকমা লাগিয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের দিবাস্বপ্নেও গুড়ে বালি! এ যেন জেনারেল ইয়াহিয়ার জন্য ‘উভয় সংকট’। বঙ্গবন্ধু একদিকে যেমন “আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন” উচ্চারণ না করে হায়েনার মত সমাবেশে তাক করে রাখা লক্ষ বুলেটকে সুপ্তাবস্থায় অঙ্কুরে বিনষ্ট করলেন, তেমনি
“তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক”
ভাষণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ প্রস্তুতির সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিলেন।
পাকিস্তানের আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীত্বের শপথ না নিলেও বৈধ প্রধানমন্ত্রীর মত রাষ্ট্রের জনগণের প্রতি আহবান জানালেন-
“আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যে আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে- সে জন্য রিকশা, গরুর গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে। শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না।”
পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মানতে লাগল। রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ল। রাষ্ট্রের সকল নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জনতা অবৈধ সরকারকে ‘না’ বলে দিল। সরকার অসহায় হয়ে পড়ল। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন জনতার অঘোষিত প্রধানমন্ত্রী। জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অসহযোগ আন্দোলনকে বানচাল করতে কুটকৌশলের আশ্রয় নিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া। জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের নতুন তারিখ ঘোষণা করলেন ২৫ শে মার্চ। ২৫ শে মার্চের অ্যাসেম্বলি বঙ্গবন্ধু ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করলেন। ২৩ শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে সূর্যোদয়ের পরপরই বঙ্গবন্ধু তার ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বাসভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করলেন। এদিন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে উত্তোলিত হল স্বাধীন বাংলার পতাকা। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী জোরালো হয় অসহযোগ আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এমন অসহযোগ আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন।
ভারতের লোকনায়ক নেতা এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বীর জয়প্রকাশ নারায়ণ একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে বলেন, “মুজিবকে সমর্থন দেওয়া গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বিশ্ববাসীর অবশ্য কর্তব্য। তিনি আরও বলেন, “গান্ধীজীর পরে শেখ মুজিবুর রহমানই এতখানি বিশাল আয়তনে অহিংস শক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতা লাভ করিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান যেরূপ সাফল্যের সহিত জনসাধারণকে সর্বাত্মক ঐক্যে তাহার পশ্চাতে কাতারবদ্ধ করিতে সক্ষম হইয়াছেন, সমগ্র ইতিহাসে অন্য কোনও নেতার জীবনে এরূপ দৃষ্টান্ত খুঁজিয়া বাহির করা খুবই দুষ্কর।”
জেনারেল ইয়াহিয়া জানতেন কোন আলোচনায় তার জন্য ইতিবাচক হবে না। এজন্য শক্তি প্রয়োগকে বাঙালি দমনের উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। একজন শেখ মুজিবকে যারা ২৩ বছর শক্তি প্রয়োগ করে দমাতে পারেনি, সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে দমানোর তাদের সেই ভোঁতা ‘শক্তি প্রয়োগ’ নীতি ছিল তাদের রণকৌশলের অপরিপক্বতারই নামান্তর। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক ২৫ শে মার্চের কালরাত্রের পৈশাচিক গণহত্যার পর নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালি ফুঁসে উঠে বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের কালজয়ী ভাষণের অনুপ্রেরণায়।
“প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।”
বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্য ছিল গেরিলা যুদ্ধ প্রস্তুতির নির্দেশনা। এই ভাষণের মাধ্যমে নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালি সেদিন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে রুপান্তরিত হয়েছিল সশস্ত্রে। কবিতার ভাষায় তাই বলতে ইচ্ছে করছে-
যে ভাষণের আবেদন চির অবিনশ্বর,
যে ভাষন সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে করেছিল নির্ভার।
নিরস্ত্র বাঙালীকে রুপান্তরিত করেছিল সশস্ত্রে,
দীক্ষিত করেছিল বাঙালীকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে।
যে সংগ্রামের ছিল দীর্ঘ ২৩ বছরের পরিব্যাপ্তি,
এক ভাষণেই ঘটেছিল তার সফল পরিসমাপ্তি।
হিমালয়সম বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠের সেই কাব্যময় ১১০৮ শব্দের ১৮ মিনিটের পৃথিবী কাঁপানো ভাষণ হিমালয়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনেছিলো মিলিয়ন জনতা। এই ভাষণের পর নিউজ উইক বঙ্গবন্ধুকে ভূষিত করে ‘Poet of Politics’ অর্থাৎ ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে। ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন-
“হয়ত এটাই আমার শেষ বার্তা।
আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।”
সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতা ঘোষণা করার অপরাধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে বন্দি করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে অতি গোপনে তাকে পাকিস্তানের কারাগারে প্রেরণ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ১২ টি অভিযোগ আনা হয় যার মধ্যে ৬ টিতে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ৭০’র নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে গঠিত হয় মুজিব নগর সরকার। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তার নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন মুজিব নগর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারী চার জাতীয় নেতা। প্রায় ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ৩০ লক্ষ শহিদ এবং ২ লক্ষ মা, বোনের সম্ভ্রম, কোটি কোটি মানুষের ত্যাগ এবং পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধুর ২৮৩ দিনের নির্মম, নিষ্ঠুর মানসিক নির্যাতন আর ঘুমহীন রাতের বিনিময়ে অবশেষে ১৬ ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের অসহায় আত্মসমর্পনের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর বঙ্গবন্ধু লন্ডন ও কলকাতা হয়ে ১০ জানুয়ারি ফিরে আসেন তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে। দেশে ফিরে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। শুরু হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন রাষ্ট্র পূনর্গঠনের কর্মযজ্ঞ। মানুষ স্বপ্ন দেখতে থাকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর। কিন্তু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ফলশ্রুতিতে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট। যে দেশের স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু তার জীবনের ৪৬৭৭ টি দিন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন, সে দেশেরই কতিপয় কুলাঙ্গার সন্তান রাষ্ট্রক্ষমতার মাত্র ১৩১৩ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে শিশুপুত্র রাসেল সহ স্বপরিবারে! অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীরা বঙ্গবন্ধুর নাম নিশানা মুছে ফেলতে চাইল। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ পর্যন্ত বাজাতে দেওয়া হতো না। ইতিহাসের কি নির্মম প্রতিশোধ জাতিসংঘের ইউনেস্কো সেই ভাষণকে আজ ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২,৫০০ বছরের ইতিহাসে পৃ্থিবীর সেরা ভাষণগুলি নিয়ে লেখক ও ইতিহাসবিদ Jakob F. Field
সম্পাদিত ‘We Shall Fight on the Beaches : The Speeches that Inspired History’ শীর্ষক গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ইতিহাস সৃষ্টিকারী ভাষণ হিসেবে স্থান পেয়েছে। বইটির ২০১ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ‘The Struggle This Time is the Struggle for Independence’ শিরোনামে মহাকালের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।
দেশের গন্ডি পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু আজ সারা পৃথিবীতে ভাস্বর। বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণমুক্ত, সুখী, সমৃদ্ধশালী, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলার- যেটি তিনি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেন নি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে তার দেখানো পথে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তার রক্ত ও আদর্শের যোগ্য উত্তরসুরী সফল রাষ্ট্রনায়ক জননেত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সমৃদ্ধির পথে অগ্রযাত্রা নির্বিঘ্ন হোক। বঙ্গবন্ধুর কাঙ্খিত বাঙালির ‘মুক্তির সংগ্রাম’ শেখ হাসিনার হাত ধরে পৌঁছাক সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে। যেমনিভাবে বাঙালির আকাঙ্খিত ‘স্বাধীনতার স্বপ্ন’ সফল হয়েছিল বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক নেতৃত্বে।
লেখক: তরুণ কলামিস্ট