প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে ‘দেশের স্বার্থ হানিকর সব চুক্তি’ বাতিল চেয়েছে বিএনপি। সরকারের সমালোচনা করে দলটি বলেছে, এ সব চুক্তি নিজ দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে শক্তিমান প্রতিবেশীকে খুশি করে ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখার সাময়িক ও ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতারা এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে দেশের স্বার্থ বিরোধী সব চুক্তি বাতিল দাবি করেন। স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন লিখিত বক্তব্য পড়েন।
বক্তব্যের শুরুতেই মোশাররফ বলেন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হওয়ায় জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নয়, এমন একটি শক্তি যখন কৌশলে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে— তখন তার পরিণতি দেশ ও জনগণের জন্য কতটা ভয়াবহ ও ক্ষতিকারক হয়, তার সাম্প্রতিক প্রমাণ প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের ফলাফল। তিনি বলেন, এ সফরে বাংলাদেশ ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি ভারতকে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে, বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে যৌথ পর্যবেক্ষণের জন্য রাডার বসানোর এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে এলপিজি গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা দিয়েছে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, আগেরবার ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আমরা যা দিয়েছি তা ভারত চিরদিন মনে রাখবে। তাহলে এবার আরও এত কিছু দেওয়ার কি প্রয়োজন ছিল? মোশাররফ বলেন, বিদেশিদের গ্যাস দিতে রাজি হননি বলে ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে পারেননি। তাহলে এবার আমদানি করা ডিউটি ফ্রি এলপিজি দেওয়ার উদ্দেশ্য কী?
খন্দকার মোশাররফ বলেন, অথচ বহু বছর ধরে তিস্তা এবং ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার ব্যাপারে শুধুই আশ্বাস চলছে। আসামের নাগরিক পঞ্জির পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক লাখ আসামবাসীকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে ভারদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আসাম রাজ্য ও কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্পষ্ট হুমকির মুখে দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতিতে এ ব্যাপারে ইতিবাচক কোনো স্পষ্ট প্রতিশ্রুতির উল্লেখ নেই। ভারতে পাটজাত দ্রব্যসহ অন্যান্যে পণ্য রপ্তানির ওপর আরোপিত অন্যায় বাধা অপসারণে নিশ্চয়তা আদায় করতেও সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
বিএনপি নেতা মোশাররফ বলেন, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ায় বাংলাদেশের অবকাঠামো, নাগরিক পরিবহন চলাচল এবং অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির নিশ্চিত সম্ভাবনা রয়েছে। সমুদ্র উপকূলে যৌথ নজরদারির ফলে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, দেশের স্বার্থ অনিশ্চয়তায় ঝুলিয়ে রেখে অন্যের স্বার্থ পূরণ করা সরকারের নতজানু নীতির প্রমাণ।
কারবালা ঠেকাতে দেশের সর্বনাশ
ফেনী নদীর পানি চুক্তির সমালোচনা করে বিএনপির এই নেতা বলেন, ফেনী নদী যৌথ নদী ছিল না। বর্তমান সরকার আরও ৬টি যৌথ নদীর সঙ্গে ফেনী নদীর নাম সংযুক্ত করে এবং এ সব নদীর পানি বণ্টন দিয়ে আলোচনায় রাজি হয়। এবার ফেনী নদীর পানি ভারতের একটি শহরে দেওয়ার চুক্তি হলো।
ফেনী নদীর এই পানি না দিলে সাব্রুম শহর কারবালা হয়ে যেত’ সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া পররাষ্ট্রসচিবের এ মন্তব্যের উল্লেখ করে মোশাররফ বলেন, কারবালা কারওরই কাম্য নয়। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিবের তো প্রথমে দেশের জনগণের স্বার্থ দেখার কথা। ফেনী নদীতে শুকনা মৌসুমে পানির অভাবে চাষাবাদের ক্ষতি, মুহুরি প্রকল্প অকার্যকর হওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা দেখেও তিনি ও তাঁর সরকার সাব্রুমকে কারবালা হতে না দিতে যতটা উদ্যোগী,Ñনিজের দেশের সর্বনাশ তাঁদের কাছে ততই মূল্যহীন। এটা কোনো দেশপ্রেমিক ব্যক্তি কিংবা সরকারের অবস্থান হতে পারে না।
‘ঠাকুর শান্তি পুরস্কার’ ছাড়া কী পেলাম?
ভারতে এলপিজি রপ্তানি চুক্তির বিরোধিতা করে বিএনপি বলেছে, বাংলাদেশ এলপিজি আমদানি করে। প্রতিবেশীর প্রয়োজনে তা রপ্তানির জন্য ইতিমধ্যে ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড ও বেক্সিমকো এলপিজি ইউনিটকে লাভবান করার এই উদ্যোগ ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিশেষকে লাভবান করবে, দেশকে নয়। এতে ভারতের প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার পথ এখন মাত্র ২০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এলপিজি গ্যাস ভারত পৌঁছাবে। ভারতকে এই সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে আমরা ‘ঠাকুর শান্তি পুরস্কার’ ছাড়া কী পেলাম?
মোশাররফ বলেন, আগেরবার ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আমরা যা দিয়েছি তা ভারত চিরদিন মনে রাখবে। তাহলে এবার আরও এত কিছু দেওয়ার কি প্রয়োজন ছিল? তিনি বলেছেন, বিদেশিদের গ্যাস দিতে রাজি হননি বলে ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে পারেননি। তাহলে এবার আমদানি করা ডিউটি ফ্রি এলপিজি দেওয়ার উদ্দেশ্য কী?
গঙ্গা চুক্তি: অসত্য তথ্য
ক্ষমতায় থাকতে বেগম খালেদা জিয়া ভারত সফরের সময় গঙ্গা নদীর পানির কথা বলতে ‘ভুলে’ গিয়েছিলেন বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটাকে ‘অসত্য ও ব্যর্থতা ঢাকার অপচেষ্টা’ বলে মন্তব্য করে মোশাররফ বলেন, ‘ওই সফর শেষে প্রকাশিত যৌথ ইশতেহারে বলা হয়, “সমতা ভিত্তিক দীর্ঘ মেয়াদি সমন্বিত প্রক্রিয়ায় দুই দেশের জনগণের সর্বোচ্চ স্বার্থে পানি বণ্টনের বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত হন।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, কোনো আলোচনা না হলে যৌথ ইশতেহারে এই বক্তব্য থাকল কী করে?
মোশাররফ বলেন, প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৫ সালের আগে গঙ্গার পানি নিয়ে কোনো চুক্তি হয়নি, সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তি হয়েছে ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে। এই চুক্তিতে যে গ্যারান্টি ক্লজ ছিল, তা ১৯৯৬ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক স্বাক্ষরিত চুক্তি থেকে বাদ দেওয়া হয়। যার ফলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আবরার বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর
বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটি। তারা বলেছে, রাতের অন্ধকারে ভোট ডাকাতির অবৈধ সরকার দেশের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী চুক্তি করেছে। এর প্রতিবাদ করায় জীবন দিতে হয়েছে আবরারকে। আবরারের পুরো বক্তব্যটি বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে, তাই আবরার বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর। তাঁর এই নির্মম মৃত্যু বৃথা যেতে পারে না। বৃথা যেতে দেওয়া হবে না, দেশের জনগণ বৃথা যেতে দেবে না।
মোশাররফ বলেন, দেশের স্বার্থবিরোধী এ সব চুক্তির প্রতিবাদে জনগণ ফুঁসে উঠেছে। সচেতন ছাত্র সমাজ আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছে। সমালোচনায় ভীত সরকার তাদের দলীয় লাঠিয়ালদের দিয়ে ফেসবুকে প্রতিবাদী পোস্ট দেওয়ার জন্য বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারকে খুন করেছে। কিন্তু এই নৃশংস হত্যাকা- আন্দোলনের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে মাত্র কাউকে ভীত করতে পারেনি। জনগণ মুক্তিযুদ্ধের সোনালি ফসল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে এই দুরাচারী শাসকের পতন চায়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ, মো. শাহজাহান, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখ।
ছবি-৭
সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই কমবেশি র্যাগিং আছে: শিক্ষামন্ত্রী
নিজস্ব প্রতিনিধি
দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই কমবেশি র্যাগিং আছে উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, সরকারের একক প্রচেষ্টায় র্যাগিং বন্ধ করা সম্ভব না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, পরিবার—সবার ভূমিকা রয়েছে। র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে বৈশ্বিক শিক্ষা পরিবীক্ষণ (জিইএম) প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষামন্ত্রী এসব কথা বলেন। ‘অভিবাসন, বাস্তুচ্যুতি এবং শিক্ষা: দেয়াল নয়, প্রয়োজন সেতুবন্ধন’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের হত্যাকা-ের ঘটনায় আমরা ক্ষুব্ধ, লজ্জিত। একজন মেধাবীর এমন নৃশংস হত্যাকা- মেনে নেওয়া যায় না। হত্যায় জড়িত হিসেবে যাদের নাম এসেছে, তাদের দ্রুত ধরা হয়েছে। অবশ্যই দ্রুততম সময়ের মধ্যে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।’
বুয়েটে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করলেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি—শিক্ষার্থীদের এমন অভিযোগের বিষয়ে সাংবাদিকেরা শিক্ষামন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন। জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বুয়েটে ছাত্রলীগসহ অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোও শক্তিশালী। শুধু সরকারসংশ্লিষ্ট বলে ছাত্রলীগ এমন করছে, সেটি বলাও গ্রহণযোগ্য না। যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিং বন্ধে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।
বুয়েটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করছেন—এ বিষয়ে সরকারের ভাবনা কী, তা জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, একজন উপাচার্য থাকবেন কি না, তাঁকে অপসারণ করা হবে কি না, সেটি ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু যাঁরা এখন আন্দোলন করছেন, তাঁরা দীর্ঘদিন এমন অন্যায় মেনে নিয়েছেন এবং চলতে দিয়েছেন। অন্যায় প্রতিরোধে নৈতিকতার জায়গা থেকে তাঁরা কী করেছেন। শিক্ষকেরা আগে সরব হলে এমন মর্মান্তিক ঘটনা হয়তো প্রতিরোধ করা যেত।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সোহরাব হোসাইনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মুনশী শাহাবুদ্দীন আহমেদ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জি এম হাসিবুল আলম, ঢাকাস্থ ইউনেসকোর প্রধান বিয়াট্রিস কালদুন, বাংলাদেশ ইউনেসকো জাতীয় কমিশনের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল মনজুর হোসেন প্রমুখ।
– নিজস্ব প্রতিনিধি