একাত্তরের ১৫ আগস্ট। আকাশের মুখ ভার,মাঝে মাঝে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। সারাদিন সূর্যের আলো ফোটেনি। চারদিকে সুনসান নিরবতা। মুক্তিপাগল তরুণ-যুবকরা গ্রাম ছেড়ে আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে গেছেন। মাগরিবের নামাজ পড়ে বৃষ্টিভেজা-কর্দমাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফিরেই বিবিসির সংবাদে নিমগ্ন হয়েছেন এমলাক হোসেন মাস্টার। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধ ঘোষণার পরপরই তার ছেলেরা প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আট ছেলেমেয়ের মধ্যে দু’জন বাদে ছয় জনই দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। বড়ছেলে আবদুল মতিন, মেজছেলে গোলাম মোস্তফা, সেজছেলে গোলাম হোসেন বন্ধু-স্বজনদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে যুদ্ধের শুরুতেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার বেতাই ক্যাম্পের আশেপাশে অবস্থান গ্রহণ করছেন। দু’ ছেলে আবুল হাশেম ও লিয়াকত আলি রয়েছেন মুর্শিদাবাদে। বাড়িতে রয়েছেন স্ত্রী মেহের আফরোজ,ছেলে জাহাঙ্গীর আলম বাবলু ও গোলাম ফারুখ। রাত আটটার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসর রাজাকার-আলবদর-আল শামসরা এমলাক হোসেনের দোতলা বাড়িটি ঘিরে ফেলে। অতর্কিত হামলা চালায় বাড়ির পাশ-ঘরের দরজায়। সজোরে লাথি মেরে ভেঙে ফেলে সদর-দরজা। ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে চিলেকোঠা থেকে নেমে আসেন অসমসাহসীছিপছিপে গড়নের এমলাক মাস্টার। উপয়ান্তর খুঁজে না পেয়েদরজা খুলে দেন ভীতসন্ত্রস্ত স্ত্রী মেহের আফরোজ। ঢুকেই শিশু, অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূ, স্ত্রী ও গৃহকর্মীর সামনেএমলাক হোসেনকেরাইফেলের বাট ও ছড়ি দিয়ে নির্দয়ভাবে পোটাতে থাকে পাক-হানাদার বাহিনীর জওয়ানরা। বেদম প্রহার ও উপর্যুপরি লাথির আঘাতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। চলতে থাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ, কিলঘুসি, লাথি, চুল ধরে টানাহেঁচড়া। তাকে যখন টানতে টানতে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসা হচ্ছে,তখন বাড়ির সবাই চিৎকার করে কাঁদছেন।ভীতসন্ত্রস্ত ছোট ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে এক জওয়ানের পা ধরে মিনতি জানাইবাবাকে ছেড়ে দেবার জন্য। কিন্তু আবেদন-নিবেদনে কোনো কাজ হয় না। চোখ বেঁধে ট্রাকে তুলেভাটপাড়া ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৫ আগস্টের গভীর রাতে তাকে ও তার বন্ধু উজির আলি মালিথ্যাসহ ৬ জন বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠককেবেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবেহত্যা করে পাশে কাজলার পানিতে লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয়। তাদের লাশ আজও স্বজন খুঁজে পায়নি। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত কাজী সাজ্জাদ আলী জহির রচিত ‘মুক্তি সংগ্রামে মেহেরপুর’ (জানুয়ারি ২০১৬) গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়, ‘১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে গাংনী থানা শান্তি কমিটির বিশেষ বৈঠকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা বুদ্ধিজীবী এবং স্থানীয় এলিটদের নিশ্চিহ্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তালিকা আগেই করা ছিল, তা কার্যকর করা হয় ১৫ আগস্ট থেকে।’
এমলাক হোসেনের জন্ম ১৯২০ সালে নদীয়া জেলার করিমপুর থানার গোয়াস-রহমতপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। বাবা উকিল বিশ্বাস ও মা মেহের নিগারের একমাত্র সন্তান তিনি।দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে তাঁর পরিবার মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার সাহারবাটী গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। গ্রামের স্কুলে পাঠ সমাপ্তির পর এমলাক হোসেন ভর্তি হন সাধক নিগমানন্দ সরস্বতী প্রতিষ্ঠিত মেহেরপুর মহকুমার স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাথুলি এনএস বিদ্যামন্দিরে। কিন্তু ব্যক্তিগত অনাগ্রহ এবং গানবাজনা ও নাটক-থিয়েটারের প্রতিপ্রবল আগ্রহের কারণে ম্যাট্রিকুলেশন পাসের পূর্বেই তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার পরিসমাপ্তি ঘটে। পেশা হিসেবে বেছে নেন ব্যবসা, চাষাবাদ ও শিক্ষকতা। ১৯৫১ থেকে ১৯৭১ পর্যন্তপ্রায় দু দশক, তিনি সাহারবাটী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে সাহারবাটী ইয়ুথ ক্লাব ও নবকল্লোল নাট্যগোষ্ঠী। জমিদানসহ পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন সাহারবাটী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাটপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় ওসাহারবাটী মধ্যপাড়া জামে মসজিদে। তিনি ছিলেন একাধারে মানবহিতৈষী সমাজসেবক, প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মী, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক এবং মুক্তিযুদ্ধের বলিষ্ঠ সংগঠক। নিজে নাটক-থিয়েটারে অভিনয় করতেন এবং শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় নিজের ছেলে ও স্থানীয় তরুণদের সহযোগিতা প্রদান করতেন। মেতে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-আব্বাসউদদীনের গান, নাটক-থিয়েটার এবং প্রগতিশীল রাজনীতি নিয়ে। পকিস্তান আমলে সামরিক শাসনের মধ্যেও নিজ বাড়ির আঙিনায় ও স্কুলমাঠে উদযাপন করতেন পয়লা বৈশাখ, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী। সরাসরি রাজনৈতিক দলে যুক্ত না হয়েও ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ষাটের দশকের স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনাযুদ্ধে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।প্রতিরোধযুদ্ধের প্রস্তুতির সূচনালগ্নে গাংনী থানার বন্দুক-মালিকদের সহযোগিতায় যে-বন্দুকবাহিনী গড়ে ওঠে, সেখানে এমলাক হোসেন পালন করেন নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা।তার বাড়িটি ছিল প্রগতিশীল রাজনীতি ও সংস্কৃতিচর্চার পীঠস্থান। মেজছেলে গোলাম মোস্তফা বামপন্থী রাজনীতির বলিষ্ঠ সংগঠক। সেই সুবাদে কমরেড আবদুল হক, তোয়াহা, দেবেন শিকদার, বদরুদ্দীন উমরের মতো বামপন্থী রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের আসা-যাওয়া ছিল এই বাড়িতে। রফিকুর রশীদের লেখা ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মেহেরপুর জেলা’ (আগামী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ২০০৭) গ্রন্থে এমলাক হোসেনকে ‘মুক্তমনা ও সংস্কৃতিপ্রাণ’ মানুষ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।এই গ্রন্থে রফিকুর রশীদ লিখেছেন, ‘সাহারবাটির আরো দুজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম হচ্ছে: এমলাক হোসেন এবং উজির মালিথ্যা। দুজনেই মুক্তপ্রাণ ও সংস্কৃতিপ্রাণ। নিজেদের ছেলেদের মানুষ করেছেন উদারনৈতিক পরিবেশে। নিজ এলাকার মানুষকে স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছেন।.. ১৫ আগস্ট গভীর রাতে তাদের হত্যা করা হয়।’ এমলাক হোসেন কোনো হোমড়া-চোমড়া রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না, মফস্বল বাসের কারণে এই প্রতিভাধর সাংস্কৃতিক সংগঠক ও প্রগতিশীল মানুষটি মেহেরপুর জেলার বাইরে খুব বেশি পরিচিত নন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে তার বীরোচিত আত্মদানের স্মৃতি ও পৌরষদীপ্ত ব্যক্তিত্ব এ এলাকার মানুষের হৃদয়ে অক্ষয় ও অম্লান হয়ে থাকবে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, খাবার দেওয়া ও অস্ত্রপাতি রাখার ব্যবস্থা করতেন। এলাকার যুবক তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করতেন।যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে যেতে উৎসাহ প্রদান করতেন।
এমলাক হোসেন এবং একাত্তরের ১৫-আগস্টের শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ভাটপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে, চলছে বধ্যভূমি সংরক্ষণের কাজ। শহীদ এমলাক মাস্টারের বড়ছেলে ভাটপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সদ্যপ্রয়াত আবদুল মতিন ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও অভিনয়শিল্পী। এখনও ছয় ছেলে ও এক মেয়ে বেঁচে আছেন। এরা সবাই শিক্ষিত, শিল্পানুরাগী ও সরকারি চাকুরে। মেজেছেলে মেহেরপুর জেলা ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আহবায়ক, মুক্তিযোদ্ধাও চারুশিল্পী গোলাম মোস্তফা বলেন, বাবা ছিলেন আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী ও বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ অনুসারী। মেহেরপুরের জাতীয় পরিষদ সদস্য ছহিউদ্দিন বিশ্বাস, প্রাদেশিক পরিষদ নুরুল হক, আওয়ামী লীগ নেতা জালাল উদ্দিন, হিসাবউদ্দিনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। উদার-অসাম্প্রদায়িক চিন্তার মানুষ হিসেবে তিনি কোনোদিন কোন সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল ও শক্তিকে সমর্থন করেননি। আমরা তিন ভাই ছিলাম স্বাধীনতার পক্ষে উচ্চকণ্ঠ, সক্রিয় রাজনৈতিক-কর্মী এবং মুক্তিযোদ্ধা। মতাদর্শগত কারণে স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতা ও রাজাকাররা বাবার উপর ক্ষিপ্ত ছিলেন।স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক-দালালদের প্রত্যক্ষ মদতে পাক হানাদার বাহিনী বাবাকে হত্যা করে। তিনি দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন, এ জন্য আমরা গর্ব অনুভব করি।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক এবং সহযোগী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ।