ইন্টারনেট দুনিয়ায় শিশুদের নিরাপদ থাকার জন্য সরকার প্যারেন্টাল কন্ট্রোল গাইড লাইন তৈরি ও মেনে চলার নির্দেশনা দিলেও এখনও তা সর্বস্তরে চালু হয়নি। দেশে ব্রডব্যান্ড (উচ্চগতি) ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কয়েকটি এই সেবা চালু করলেও মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো এখনও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। কবে নাগাদ চালু করবে এমন তথ্যও জানা যায়নি।
তবে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, শিগগিরই মোবাইল অপারেটরগুলো পরিপূর্ণরূপে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে। এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করলে অপারেটরগুলোকে বাধ্য করা হবে বলে তিনি জানান। তিনি আরও জানান, আইএসপিগুলো এখনই বাস্তবায়ন না করলেও কোনও সমস্যা হবে না। লাইসেন্স নবায়ন করার সময় এটা করতে বাধ্য করা হবে। যারা প্যারেন্টাল কন্ট্রোল চালু করবে না তাদের লাইসেন্স নবায়ন করা হবে না।
প্রসঙ্গত, প্যারেন্টাল কন্ট্রোল হলো সেই প্রযুক্তি যা শিশুদের জন্য আপত্তিকর বা অনুপযুক্ত হতে পারে এমন ওয়েবসাইট ব্লক বা ওয়েবসাইটের কন্টেন্ট ফিল্টার কিভাবে করতে হয় তার ব্যবস্থা করে।
গত বছর দেশের একটি আইএসপি প্রতিষ্ঠান বিডিকম অনলাইন প্যারেন্টাল কন্ট্রোল প্রযুক্তি চালু করে। যদিও সরকার পরে এটি মেনে চলার ঘোষণা দেয় এবং গাইডলাইন তৈরি করে। এরই মধ্যে আম্বার আইটি, অগ্নি সিস্টেমস, অপটিম্যাক্স কমিউনিকেশন লিমিটেডসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই সেবা চালু করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনও ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ও মোবাইল অপারেটর নিজের ইচ্ছেতে এটা চালু করতে চায় না। কে চায় তার ব্যবসায় লাভ কমে যায়। মূলত সরকারের নির্দেশনা দানের পরে আইএসপিগুলো প্যারেন্টাল কন্ট্রোল চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। অভিভাবকরা চাইলে আইএসপিগুলো প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সেবা দিচ্ছে।
কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিজেরাই প্যাকেজ অফার করছে। মূলত বাবা-মায়েদের সচেতনতার অভাবেই প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সেবাটি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন ইন্টারনেট ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা। প্রচার-প্রচারণার অভাবকেও দুষছেন কেউ কেউ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, আমি যত বেশি ডিজিটাল হচ্ছি, আমার ততো বেশি ডিজিটাল নিরাপত্তার সংকট তৈরি হচ্ছে। এই নিরাপত্তার হুমকিটা আসলে বহুমাত্রিক। আমি এতদিন বলে এসেছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কথা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই শুধু নিরাপত্তা ঝুঁকি নয়, আমার চারপাশের সবকিছু- মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসে যখন আমি কাজ করছি তখন এটাও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, পেমেন্ট সিস্টেমও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। ব্যাংকের টাকাও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
এমনকি ওয়েবসাইটও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। এই যে সামগ্রিকভাবে ঝুঁকিটা বাড়ছে, এই ঝুঁকিটা কমানোর অন্যতম উপায় হচ্ছে সচেতনতা। এই সচেতনতার জায়গাটাকে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের জন্য আমার এই প্যারেন্টাল গাইডেন্স।
মন্ত্রী বলেন, এটা দেওয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে আমাদের অভিভাবকরা যেন সন্তানদের তাদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমি নিয়ন্ত্রণের কথা বলছি এ কারণে যে, নিয়ন্ত্রণটা আমার উদ্দেশ্য নয়, বিষয় হলো মনিটর করা। অল্প বয়সের ছেলেমেয়েদের বাবা মায়েরা এটা ঠিক করে দেয় কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যাবে, কার সঙ্গে নয়। কারণ বন্ধুর প্রভাব তার জীবনে এসে পড়ে। এই বাবা মায়েরা যাতে মনিটর করতে পারে এটা সেজন্য।
তিনি আরও বলেন, তোমার হাতে যদি একটা ডিজিটাল হাতিয়ার থাকে তাহলে তুমি তোমার সন্তানকে সঠিক পথের নির্দেশনা দিতে পারবে। আমি এইজন্যই নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছি। ফলে ২৪ ঘণ্টা ইন্টারনেট খোলা রাখলেও কোনও সমস্যা নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, মোবাইল অপারেটররা মনে হয় এখনও শুরু করেনি। তবে আমি যখন প্যারেন্টাল কন্ট্রোল গাইডেন্স অর্ডার দিয়েছি তখন আমি সবার জন্যই দিয়েছি। আমরা প্রথম স্তর বলে ওইসব জায়গায় এখনও কড়াকড়ি আরোপ করিনি। একটা সার্টেন স্টেজে গিয়ে আমরা কড়াকড়ি আরোপ করবো। আইএসপিগুলোর লাইসেন্স ইস্যুর শর্ত হলো প্যারেন্টাল কন্ট্রোল গাইডেন্স চালু করা।
এ বিষয়ে ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবির সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হক বলেন, আমাদের সদস্যরা (আইএসপিএবির সদস্য) প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সেবাদানের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। অভিভাবকরা চাইলেই তারা সেবা দিতে পারবে। অনেকে সেবা দিচ্ছেও। তবে গ্রাহকদের কাছ থেকে অনুরোধ আসতে হবে।
অনুরোধ পেলেই আইএসপিগুলো এই সেবা দেবে। ইউজার লেভেল থেকেও তারা অনুরোধ কম পাচ্ছেন বলে জানান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,আইএসপিএবি-ও এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
এই সেবাদানে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান বিডিকম অনলাইন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম গোলাম ফারুক আলমগীর আরমান বলেন, আমরা এক বছর আগেই এই সেবাটা দিতে শুরু করেছি। সাড়া মোটামুটি। এই সেবা দিতে আমাদের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।
তারপরও আমরা দিচ্ছি। আমরা এখন প্রমোশনাল অফারে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল রাউটার ফ্রি দিচ্ছি। এটা আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) থেকেই দিচ্ছি। কারণ আমরা ইথিক্যাল বিজনেস পলিসি মেনে চলি।
সাড়া কেমন পাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভালো। তবে আরও ভালো হতে পারতো। তিনি জানান, তার প্রতিষ্ঠান ৫৩টি ক্যাটাগরিতে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সেবা দিচ্ছে। যদিও তারা এটাকে বলছেন নিরাপদ ইন্টারনেট সেবা।
তিনি বলেন, প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সেবায় যে ৫৩টি ক্যাটাগরি বেছে নেওয়া হয়েছে তাতে করে আমাদের ইন্টারনেট সেবা সম্পূর্ণ নিরাপদ। শিশুদের হাতে ইন্টারনেট তুলে দিয়ে বাবা-মায়েরা নিরাপদে থাকতে পারবেন। কোনও অ্যাডাল্ট (পর্ণ সাইট) কনটেন্ট, জুয়ার সাইট, সংহিত কোনও দৃশ্য, ধর্মীয় উগ্রবাদী ইত্যাদির লিংক,তথ্য,ভিডিও চিত্র আসবে না।
এস এম গোলাম আলমগীর আরমান জানান, কনটেন্ট ফিল্টার ও কনটেন্ট ব্লক এই দুইভাবেই আমরা নিরপাদ ইন্টারনেট দিচ্ছি। এছাড়া আমরা বাড়ির বড়দের জন্য একটা এসএসআইডি এবং পাসওয়ার্ড দিচ্ছি যেটা ওপেন। সবকিছু ব্রাউজ করা যাবে।
আর শিশুদের জন্য দিচ্ছি আরেকটি এসএসআইডি। সেটা দিয়ে শিশুরা তাদের উপযোগী সব দেখতে পাবে। এছাড়া কনটেন্ট ব্লকিং মোডে ইন্টারনেট সংযোগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ করা যাবে। ধরা যাক, দিনের বিভিন্ন সময়ে গৃহ শিক্ষক, আরবি শিক্ষক বা গানের শিক্ষক আসেন।
এছাড়া বাড়ির সন্তানটির পড়ার জন্য সময়ও বরাদ্দ রয়েছে। আগে থেকে সেই সময় অনুযায়ী নির্দেশনা দেওয়া থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই সময়ে ইন্টারনেট সংযোগ শিশুদের জন্য বিচ্ছিন্ন থাকবে। চাইলেও ওই সময় ইন্টারনেটে সংযোগ দেওয়া যাবে না।
আম্বার আইটি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী আমিনুল হাকিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠান পৃথক কোনও হার্ডওয়্যার সরবরাহ করছে না। ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার সময় একটি প্যানেল তৈরি করে দিচ্ছেন। সেই প্যানেলে লগইন করে গ্রাহক কী চান আর কী চান না তা নির্ধারণ করে দিতে পারছেন।
ফলে একজন বাবা, মা জানেন তা সন্তান কি দেখছে। এখন কাজ সেরে বাসায় ফিরে তারা মনিটর করতে পারছেন তাদের সন্তান কোন কোন সাইটে গিয়েছে, ইউটিউবে কী দেখেছে ইত্যাদি। সদ্য সমাপ্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ মেলায় আম্বার আইটি এই সেবা উদ্বোধন করে বলে তিনি জানান। সাড়াও ভালো পাচ্ছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তবে মোবাইল অপারেটরগুলো প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সেবাদানে পিছিয়ে। মোবাইল অপারেটর রবি কিছুদিন আগে এই সেবা চালু করলেও এখন তাদের সেবাটি আর চালু নেই। অন্য অপারেটরগুলো এই ব্যাপারে এখনো উদ্যোগী হয়নি বলে জানা গেছে।