চট্টগ্রাসের মিরসরাইয়ের আজমপুর বাজারে তাণ্ডব করছিল বিএনপি কর্মীরা। এরই ছবি তুলছিল জাহেদ। আজকাল সবাই যেমন তোলে। রুমনের মামা ইউনুস নূরী জানান, তখন ছবি তোলার অপরাধে বিএনপি নেতাকর্মীরা ধাওয়া করে রুমনকে। সে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। একসময় তাঁরা তাকে মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে বিএনপির এক কর্মী। এতে সে পাশের পুকুরে পড়ে যায়। এরপর তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। মিরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক খন্দকার নোমান সায়েরী্ও জানান, মাথায় আঘাতজনিত কারণে রুমনের মৃত্যু হয়েছে।
এই মৃত্যু নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। রুমন কোন দলের কর্মী। আদৌ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কী না। আরও নিশ্চই হবে। কিন্তু তাতে এখন মৃত রুমনের কিছু যায় আসে না। যায় আসে তার পরিবারের। বাবাহীন এই কিশোর মা নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছিলেন ছেলেটি বড় হবে, তাঁর দুঃখ ঘোচাবে। কিন্তু সেই স্বপ আজ অতীত। যেরকম ভাবে ২০১৩-১৪ সালে অতীত হয়েছিল আরও বহু পরিবারের স্বপ্ন ।
আমরা যদি একটু পেছনে তাকাই তাহলে দেখবো, সন্ত্রাস করে এরকম রুমনের মত শিশু কিশোরদের ভবিষ্যত নষ্ট করা গল্প বিএনপির ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। পেট্রোল বোমা ও ককটেল ছোড়ার যে অপরাজনীতি তা বিগত কয়েকটি নির্বাচনের আগে আমরা দেখেছি। তাদের উদ্দেশ্য যেভাবে হোক ক্ষমতা দখল করতে হবে। সেনাছাউনি থেকে উঠে আসা একটি দল। তাদের কাছ থেকে দেশের মানুষ এর চেয়ে বেশি আর কি বা আশা করতে পারে। আমরা বিএনপির রাজনীতিতে শিশু হত্যার যে নারকীয় ইতিহাস সেখানে একবার চোখ বুলিয়ে নিতে পারি।
২০০২ সালের ৯ মে রামপুরায় বাবার কোলে থাকা ২০ মাসের শিশু নওশিন ছিনতাইকারীদের গুলিতে নিহত হবার পর শোকার্ত পরিবারের প্রতি চারদলীয় জোট সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন, “আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে”। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি বিএনপির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ ধরনের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই বোঝা যায়, শিশু-কিশোরদের প্রতি তাদের অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে সমর্থন করায় ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার চরমোতাহা গ্রামের মোর্শেদ আলীর চার মাসের বাচ্চাকে মায়ের কোল থেকে ফেলে দিয়ে থেঁতলে হত্যা করেছিল বিএনপির নেতা-কর্মীরা। চার মাসের বাচ্চাকে হত্যা করার পরেও তারা মোর্শদের স্ত্রীকে সারা রাত ধর্ষণ করে।
২০০২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার পোয়ালগুরা দড়িপাড়া গ্রামের এতিম কিশোরীকে ধর্ষণ করে ইউনিয়ন বিএনপির এক নেতা। রাজশাহীর বাগমারায় ২০০২ সালের ২১ মার্চ ৭ বছরের এক শিশুকে তুলে নিয়ে যায় সরকার সমর্থক পাঁচ সন্ত্রাসী। গণধর্ষণ করা হয় ৭ বছরের ওই শিশুকে। একই বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি স্কুল ছাত্র শিহাবকে অপহরণ করা হয়। তার বাবার কাছে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। টাকা দেয়ার আগেই শিহাবকে ১২ টুকরো করে হত্যা করা হয়।
২০০১-২০০৬ সালের বিএনপির শাসনামলে সংবাদপত্রের তথ্যানুযায়ী, শিশু-কিশোরদের ককটেল বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। ২০১৩ সালের তাদের অগ্নি-সন্ত্রাসের বড়ো হাতিয়ার ছিল এসব শিশু-কিশোররা । তাদের টাকার বিনিময়ে এসব কাজ করানো হতো। ২০১৩-১৫ সাল অব্দি চলমান আগুন সন্ত্রাসে গ্রেফতার অনেকেই ছিল কিশোর। তারা পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিয়ে স্বীকার করেছে যে, টাকার বিনিময়ে বিএনপির নির্দেশে এবং তাদের সরবরাহকরা পেট্রোল বোমা দিয়ে তারা এ সন্ত্রাস করেছে।
এই শিশু-কিশোরদ সুরক্ষা দিতে কাজ শুরু করে বর্মান সরকার। শিশুদের সুরক্ষার জন্য প্রথমেই জাতীয় শিশুনীতি-২০১১ প্রণয়ন করে। বাংলাদেশে শিশু অধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই আইনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ নীতিতে শিশু বলতে ১৮ বছরের কম বয়সী এবং কিশোর বলতে ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের ধরা হয়।
সরকার কাজ করছে শিশুর নিরাপদ জন্ম ও সার্বিক বিকাশ নিশ্চিতকরণ, শিশুর দারিদ্র বিমোচন, শিশু স্বাস্থ্য, শিশুর বিকাশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, শিশু শিক্ষা, শিশুর বিনোদন, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, শিশুর সুরক্ষা, প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য বিশেষ কার্যক্রম, অটিস্টিক শিশুর জন্য বিশেষ কার্যক্রম, শিশুর জন্ম নিবন্ধন, অনগ্রসর ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কার্যক্রম, দুর্যোগের সময় ও দুর্যোগের পরে শিশুর সুরক্ষা, শিশুর অংশগ্রহণ ও শিশু মতামত গ্রহণসহ শিশু অধিকার বাস্তবায়ন নিয়ে।
কন্যা শিশুদের অগ্রাধিকার দিয়েছে শেখ হাসিনা সরকার । ৩০ সেপ্টেম্বর জাতীয় কন্যাশিশু দিবস হিসেবে পালন করছে সরকার। এবছরও ‘বিনিয়োগে অগ্রাধিকার, কন্যাশিশুর অধিকার’-এ প্রতিপাদ্য নিয়ে দেশব্যাপী উদযাপিত হয়েছে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস-২০২৩। কন্যাশিশুদের শিক্ষার জন্য অবৈতনিক শিক্ষার প্রচলন করে শেখ হাসিনা সরকার। মেয়েদের দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারীর ক্ষমতায়নের দুটি মূল উপাদান-হিসেবে চিহ্নিত করে নারী শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। ২০১০ সাল থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হয়েছে এবং নারী শিক্ষার ক্রমবর্ধমান হারের ফলে বাল্যবিবাহের হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলেই এদেশে প্রথমবারের মত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করা হয়, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল, যুগ যুগ ধরে নির্যাতিত ও অবহেলিত এদেশের বৃহত্তর নারী সমাজের ভাগ্যোন্নয়ন করা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে জেন্ডার সম্পৃক্ত বরাদ্দের পরিমাণ ২ লাখ ৬১ হাজার ৭ শত ৮৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং জিডিপি’র ৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। বাজেটে ২৭টি মন্ত্রণালয় ও ১৭টি বিভাগের জন্য পৃথক জেন্ডার বাজেট প্রণয়ন করা হয়। যা নারী ও কন্যাশিশুদের সার্বিক অধিকার রক্ষায় ব্যবহৃত হবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রণীত উপবৃত্তি কার্যক্রমের আওতায় প্রায় ২৫ মিলিয়ন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন উপবৃত্তি এবং বৃত্তি কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে। উপবৃত্তির অর্থ সরাসরি তাদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মা অথবা বৈধ অভিভাবকদের কাছে পৌঁছাচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৭৪,৮২,৩১,৭০০ টাকা সরকার উপবৃত্তি দিয়েছে। নারী শিক্ষকদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার উদ্যোগ আওয়ামী লীগের আমলেই গৃহীত হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় এখন শিক্ষক পদের ৬০ শতাংশ নারীদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সরকারি চাকরিতে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত রয়েছে।
কন্যা শিশুর অগ্রাধিকারমূলক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ প্রণয়ন করে আওয়ামী লীগ সরকার। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধিত) আইন-২০২০ এবং যুগোপযোগী বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকারের গৃহীত এসব পদক্ষেপের ফলে বিদ্যালয়ে ছাত্রী ভর্তির হার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাল্যবিবাহ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ক্রীড়াঙ্গনেও আমাদের মেয়েরা ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে।
ব্রিকস সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত এক মধ্যাহ্নভোজে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই অঞ্চলের নারী ও বালিকাদের ‘পরিবর্তনের কারিগর’ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এসডিজির পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি গ্লোবাল সাউথ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের নারীবান্ধব শিক্ষানীতির কারণে দেশে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরে মেয়েদের তালিকাভুক্তি বেড়েছে ৯৯ শতাংশ। মেয়ে-ছেলে স্কুলে তালিকাভুক্তির অনুপাত ৫৩:৪৭-এ উন্নীত হয়েছে।
আয়ামী লীগ সরকারের শাসনামল মূল্যায়ন করে আজ একথা অন্তত বলা যায় যে তারা ক্ষমতায় থাকুক কিংবা না থাকুক তাদের কাছে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা সর্বাগ্রে। কারণ আজ পর্ন্ত এই সরকারের বিরুদ্ধে শিশু কিশোর বিরোধী কোন পদক্ষপের তথ্য তাদের বিরোধী পক্ষের কাছেও নেই।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।