রাজনীতির মাঠে সংলাপ শব্দটি আবারও ঘুরতে শুরু করেছে। বহুল আলোচিত ২৮ অক্টোবরের পর এবার শর্তহীন সংলাপের বিষয়টি সামনে এনেছেন আরেক আলোচিত কূটনীতিক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির সহিংসতার পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস হরতাল অবরোধের মধ্যেই নির্বাচন কমিশন ভবনে গিয়ে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের সাথে বৈঠক করলেন। যদিও বৈঠকটি পূর্ব নির্ধারিত ছিলো না। সিইসির সঙ্গে বৈঠক সেরে বেরিয়ে এসে নিজেই সাংবাদিকদের সামনে এসে কথা বললেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পুরোনো কথাগুলো বললেন। শেষ দিকে এসে বললেন গণতান্ত্রিক নির্বাচনে কোনো পক্ষের রাজনৈতিক সহিংসতার কোনো স্থান নেই। তার আশা সব পক্ষ শর্তহীনভাবে সংলাপে বসে সামনের দিকে এগোবে। পিটার হাসের সাথে সুর মিলিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরাও শর্তহীন সংলাপের বিষয়টি আলোচনায় এনেছেন। ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতও সরকারের মন্ত্রীদের সাথে দেখা করে শর্তহীন সংলাপের প্রসঙ্গটি তুলেছেন।
এতো গেলো মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও তাদের সঙ্গী সাথীদের কথা। এখন প্রশ্ন হলো বিএনপি কি সংলাপে বিশ্বাসী? এ প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ বা না এরকম এককথায় না দিয়ে একটু বিশ্লেষণে আসা যাক। দলটি কখনোই যে কোনো সংলাপ করেনি তা কিন্তু নয়। তারা যে সংলাপগুলো করেছে তা সফল হয়নি কারণ তারা সব সময়ই শর্ত জুড়ে দিয়েই আলোচনার টেবিলে যেতে চায়। আমরা ২০০৬ সালে আব্দুল জলিল ও মান্নান ভূঁইয়ার সেই সংলাপের কথা কিন্তু আমরা ভুলে যায়নি। সংলাপটি কেনো ভেস্তে গিয়েছিলো তা কিন্তু পরে আমরা পরিস্কার হয়েছি। দুই নেতাই সে সময় প্রায় একটা সমাধানে চলে এসেছিলেন কিন্তু খালেদা জিয়ার গ্রিন সিগন্যাল না থাকায় সেসময় দুজনের সংলাপটি ভেস্তে যায়। তার পরের রাজনীতির চিত্র আমরা দেখেছি।
২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে ফোন করে আলোচনার জন্য ডেকেছিলেন। খালেদা জিয়া সেসময় সাড়া দেননি। এরপর তো সবাই জানেনই বিএনপি তার সঙ্গী স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে সাথে নিয়ে অবরোধের নামে বেছে নিলো আগুন সন্ত্রাসের পথ। বহু নিরপরাধ মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করেছে বিএনপি-জামাতের সন্ত্রাসীরা।
২০১৮ সালেও ড.কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি জোট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সংলাপে বসেছিলো। তারা সেই নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিলো। এক একটি আসনে একাধিক প্রার্থী দেয়ার পাশাপাশি মনোনয়ন বাণিজ্য সামনে আসায় নির্বাচনের পর থেকেই শুরু হয় মিথ্যাচারের রাজনীতি।
এবার আসা যাক সাম্প্রতিক পরিস্থিতির দিকে। শর্তহীন সংলাপের কথা পিটার হাসই যে নতুন বললেন তা কিন্তু নয়। ২৮ অক্টোবর বিএনপির তাণ্ডবের আগে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব না দিলেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শর্তহীন সংলাপের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি একেবারে শুরুতেই তা নাকচ কওে দেয়। মির্জা ফখরুল সাহেব থেকে শুরু করে দুদু-রিজভীরা শর্তজুড়ে দিয়ে বলতে থাকলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকার মানলেই কেবল সংলাপ। এভাবে শর্ত দিয়ে কি সংলাপ হয়? আপনারা শেখ হাসিনার পদত্যাগ চান তাহলে সংলাপ করবেন কার সাথে?
এবার আরেকটু পিছনের দিকে যাই গত বছরের জুলাই মাসে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও অংশীজনদের সাথে সংলাপে বসেছিলো। কিন্তু বিএনপি সে সংলাপে যায়নি। শুধু বিএনপিই নয় তাদের সমমনা দলসহ ৯টি দল সংলাপে যায়নি। এমনকি ইসি গঠনে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সংলাপে এর আগে দু’বার গেলেও শেষবার তারা গর হাজির। তাদের অভিযোগ ছিলো ইসি গঠনে তাদের কোনো মতামতই নাকি রাখা হয়না। যদিও বর্তমান সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নামের প্রস্তাবক বিএনপিরই ঘনিষ্ঠ প্রয়াত ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
এবার আবারো আসি সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে। হাস সাহেবরা সংলাপের প্রসঙ্গটি সামনে আনার পর ঠিক সংলাপ আকারে না হলেও নির্বাচন কমিশন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করছে তাদের প্রস্তুতি জানাতে। কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকে এজন্য আগেভাগেই চিঠিও পাঠিয়েছে। বিএনপির চিঠি পৌঁছেছে পল্টনের কার্যালয়ে। তবে সেখানে চিঠি সংগ্রহ করার মতো কেউ ছিলেন না। চিঠিটি পড়ে আছে কলাপসিবল গেটের ভিতরে একটি চেয়ারে। চিঠি যাওয়ার খবর শুনে অজ্ঞাত স্থান থেকে রুহুল কবির রিজভী বরাবরের মতোই এ নির্বাচন কমিশনের আলোচনায় যাবেন না বলে জানিয়ে দেন।
এতোদিন বিএনপি যাদের ওপর নির্ভর করেছিলো, যে পিটার হাসকে অবতার ভাবতে শুরু করেছিলেন বিএনপির নেতারা এখন তার প্রস্তাব করা সংলাপেও ভরসা রাখতে পারছে না দলটি। আসলে দলটি কি চায়? তারা তো সংলাপ চায় না। সংলাপ চাইলে কি ২০১৪ সালে খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার সংলাপের প্রস্তাবটি অসৌজন্যমূলকভাবে প্রত্যাখান করতে পারতেন?
বিএনপি তার পুরোনো অবস্থান থেকে একচুলও সরেনি। সংলাপে নয় অবরোধের আগুনেই ভরসা রাখছে তারা। বিএনপি যে সহিংস সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে তার প্রমাণ তারা প্রতি পদে পদেই দিচ্ছে। আসলে তারা কোনোকালেই জনতায় ভরসা রাখতে পারেনি। তারা চিনেছে শুধু ক্ষমতা তাও আবার পেছনের দরজা দিয়ে। মিলিটারি ডিক্টেটর জিয়াউর রহমান পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা দখল করে বিএনপির জন্ম দিয়েছিলেন। হ্যাঁ-না ভোট, ২০০১ সালের কারচুপির নির্বাচন, ২০০৭ সালে ক্ষমতা ছাড়তে টালবাহানার পর এখন সহিংসতার পথে রক্তপাত ঘটিয়ে ক্ষমতা চায় দলটি।
বিএনপিকে বলবো যাদের ওপর আশা করে আছেন, যাদের মুরুব্বি মেনেছেন, যাদের প্রভু ভাবছেন তাদের কেউই আপনাদেরকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিতে পারবে না। তাই আগুন সন্ত্রাসের পথ ধরে ক্ষমতায় যাওয়ার আশা ছেড়ে জনতায় ভরসা রাখুন। এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো- দলটি কি পারবে লন্ডনি প্রেসক্রিপশন থেকে বেরোতে? যদি না পারে তাহলে ওই প্রবাদটিই সত্য বলে ধরে নিতে হবে ‘চোরাই না শোনে ধর্মের কাহিনী’।
লেখক: সাংবাদিক ও সাবেক ছাত্রনেতা।