চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফয়সাল (ছদ্মনাম) সরকারি চাকরির সুবাদে থাকেন খুলনায়। অবসর পেলেই সময় কাটানোর জন্য ছুটে যান খুলনার হাদিস পার্কে। সুরভি (ছদ্মনাম) রুপসার মেয়ে কেনাকাটা করতে গিয়ে বান্ধবীর সাথে যান হাদিস পার্কে, সেখানেই পরিচয় হয় ফয়সালের সাথে।
পরিচয়ের সূত্র ধরে মোবাইলফোনে নম্বর বিনিময়। মাঝে মাঝে মোবাইলে কথাবার্তা চলে দুজনের মধ্যে। সময়গুলো বেশ ভালই কাটছিলো ফয়সাল ও সুরভির। সময় যতই গড়ায় সম্পর্ক ততো গভীর হচ্ছে। সুরভি হঠাৎ চাকরির সন্ধানে চলে আসে ঢাকায়, পরিচয় হয় সাংবাদিক বকুলের (ছদ্মনাম) সঙ্গে।
সাংবাদিক বকুল অসহায় মানুষদের বেশ সাহায্য সহযোগিতা করেন। তিনি মিরপুর এলাকার একটি মানবাধিকার সংস্থার উচ্চপদস্থ কমকর্তা। বকুল সাহেবের এক আত্মীয় গণভবনের কমকর্তা। রাষ্ট্রের বড় বড় আমলা, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা সকলের সাথেই বকুল সাহেবের সখ্য। বকুল সাহেব চাইলেই একটা চাকরি জোগাড় করে দিতে পারেন সুরভিকে।
সুরভি, বকুল সাহেবকে বেশ সম্মান করেন। কেনই বা করবেন না একমাত্র বকুল সাহেবই পারেন তার দুঃখ দূর করতে। সুরভির স্বপ্নের সেই সোনার হরিণ বকুল সাহেবের কাছে ডাল-ভাত। সুরভির থাকার কোন জায়গা নাই, দূরসম্পর্কের আত্মীয় বাড়ি কদিনই বা থাকা যায়। সুরভি বকুল সাহেবকে তার সমস্যার কথা বললে বকুল সাহেব সুরভিকে ধৈর্য্য ধরতে বলেন। যে কোন চাকরি তো আর তাকে দেওয়া যায়না।
বেশ কয়েক জায়গায় কথা হয়েছে তবে ভালো চাকরির জন্য একটু সময় দিতে হয়। এভাবেই সময় গড়াতে থাকে এদিকে সুরভির আত্মীয় সুরভিকে আর রাখতে চায় না তাদের বাসায়। ঢাকা শহরে ছোট্ট বাসায় কয়দিনই বা রাখা যায়। সুরভি বকুল সাহেবকে ফোন করলেই বকুল সাহেব তার ব্যস্ততার কথা শুনান। তার হাতে কতো কাজ, সে সব সময় মন্ত্রী, আমলাদের সাথের মিটিংয়ে থাকেন।
সুরভি নাছোড়বান্দা হয়ে বার বার ফোন করেন বকুল সাহেবকে! তার পক্ষে আর ঢাকা থাকা সম্ভব না! বকুল সাহেব সুরভিকে বলেন তার একটা ফ্ল্যাট খালিই থাকে মাঝে মধ্যে সে যায় সেখানে। সুরভি চাইলেই থাকতে পারবে সেখানে। সুরভি বকুল সাহেবের প্রস্তাবে সাথে সাথে রাজি হয়ে যায়। কতো বড় মনের মানুষ হলে এতো বড় উপকার করে মানুষ। বকুল সাহেবের কথা শুনে তার উপর হাজার গুন শ্রদ্ধা বেড়ে যায় সুরভির।
ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়ে সুরভি উঠে পড়লো বকুল সাহেবের ফ্ল্যাটে। এক রুমে সুরভি আর পাশের রুমে থাকে বকুল সাহেব। ইদানিং সুরভিকে বেশ সময় দেন বকুল সাহেব ভালোবাসার কথা শুনায়। ধীরে ধীরে সুরভিও বকুল সাহেবকে ভালোবেসে ফেলে। এভাবে ভালোই কাটছিলো তাদের সময়। ইদানিং বকুল সাহেব তার লোকজনের কাছে সুরভিকে স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। বাড়ির মালিকও সুরভিকে বকুল সাহেবের স্ত্রী হিসেবে জানেন। বিয়ে ছাড়াই স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বকুল-সুরভির সংসার নব উদ্দ্যমে চলতে থাকে। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে কিছু দিন যাওয়ার পরেই বকুল সাহেব বিভিন্ন লোকজনকে সুরভির শয্যা সঙ্গী বানাতে শুরু করে। সুরভি প্রথম দিকে আপত্তি করেও তেমন লাভ হয়নি, কারণ বকুল সাহেব খুবই প্রভাবশালী।
বকুল সাহেব সুরভিকে মোবাইল ফোনে বেশ কিছু ছবি দেখান। সেসব ছবিতে বকুল সাহেব রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিদের সাথে বসে গল্প করছেন, খাচ্ছেন তাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে বকুল সাহেব অতিথি। বকুল সাহেব সুরভিকে বলে যে, পুলিশ তার কথায় উঠে বসে। তাই এখন থেকে সে যা বলবে সুরভি যেন তাই শুনে। সুরভি ভয়ে ভয়ে সম্মতি দেয়। বকুল সাহেব একটি মোবাইল নম্বর দিয়ে সুরভিকে বলে এই লোকের সাথে ভালোবাসার অভিনয় করে বাসাতে নিয়ে আসতে হবে।
সুরভি বকুল সাহেবের দেওয়া মোবাইল ফোনে কথা বলে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করে। বকুল সাহেবের পরিকল্পনা মতো একদিন দাওয়াত করে বাসাতে এনে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে বকুল সাহেব তার মেবাইলে ছবি ও ভিডিও ধারণ করে। ভুক্তভোগীর পরিবারের কাছে ধারণকৃত ছবি পাঠিয়ে দিবে,পুলিশে ধরিয়ে দিবে বলে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে। এভাবে বেশ টাকা পয়সা আয় হচ্ছে সুরভির। বেশ সুখেই কাটছিলো সুরভিদের দিন। এদিকে হঠাৎ একদিন ফয়সালের ফোন, ফয়সালের ফোন পেয়ে বেশ খুশি সুরভি। ঢাকায় আসার পর থেকে খুব একটা কথা বলা হয় না ফয়সালের সাথে। তাই দুজনেই অনেকক্ষণ কথা বলে।
ফয়সাল ঢাকাতে আসবে, দেখা হয় না অনেক দিন তাই ফয়সাল দেখা করতে চায়। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। সুরভি বকুল সাহেবকে সব খুলে বলেন। বকুলের পরিকল্পনা মতো সুরভি ফয়সালকে বাসাতে নিয়ে আসে। বাসায় কেউ নাই তাই দরজা খোলা রেখে ফয়সাল সুরভি একান্তে অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে থাকে। এদিকে বকুল সাহেব আগে থেকেই তার সহযোগীদের নিয়ে ফাঁদ পেতে অপেক্ষা করতে থাকে, ভিডিও ধারণ করে। হঠাৎ সুরভির কক্ষে চার পাঁচ জন প্রবেশ করে ফয়সাল সুরভির নগ্ন ছবি ধারণ করে, পরিবার ও অফিসে প্রেরণের উদ্যোগ নেয়। ফয়সাল বকুল সাহেবের পায়ে ধরে বিষয়টি মিটমাট করার জন্য অনুনয়-বিনয় করতে থাকে।
শেষমেষ বকুল সাহেবদের মন গলে, চার লক্ষ টাকা দিতে পারলে ফয়সালের মুক্তি মিলবে। কিন্তু এতো টাকাতো ফয়সালের কাছে নাই! তার কাছে মাত্র ১১,০০০/- টাকা ছিলো যা আগেই বকুল সাহেবরা নিয়ে নিয়েছে। ফয়সাল তার এক আত্মীয়ের থেকে বিকাশের মাধ্যমে ১,০০,০০০/- টাকা আনায় এবং অবশিষ্ট তিন লক্ষ টাকা ধার স্বরূপ নিয়েছে মর্মে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে দিয়ে মুক্তি লাভ করে। মুক্তির পর থেকে অনবরত বকুল গং রা অবশিষ্ট তিন লক্ষ টাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে, না দিলে তার অন্তরঙ্গ ছবি ও ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকে। টাকার জন্য ফয়সাল পাগলপ্রায়, পরিচিত আত্মীয়, বন্ধু, বান্ধব সবার কাছে টাকা ধারের চেষ্টা করতে থাকে। ফয়সালের অস্থিরতা দেখে সকলের সন্দেহ হয়।
পরিবারের সদস্যরা জানতে চায় হঠাৎ এতো টাকা কি কাজে লাগবে? ফয়সাল কৌশলে সকলের প্রশ্ন এড়িয়ে বারবার টাকা চায়। এদিকে বকুল সাহেব বিভিন্ন উপায়ে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। কখনো মেজর, কখনো সাংবাদিক পরিচয়ে ফোন করে পাওনা টাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। সাথে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি তো আছেই। এদিকে ফয়সালের ছুটি শেষ, কাজে যোগ দিতে হবে। অফিসে যদি ঘটনাটি জানে তাহলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে! কি করবে? ফয়সাল কোন কিছু ভেবে না পেয়ে পরিবারের কাছে ঘটনাটি খুলে বলে।
ফয়সালের ভাই আসাদুজ্জামান বাদী হয়ে মিরপুর মডেল থানায় এজাহার দায়ের করলে মিরপুর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ স্যার এজাহার গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট মোবাইল পার্টিকে দ্রুত ঘটনাস্থলে প্রেরণ করেন এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ঘটনাটি অবহিত করেন।অফিসার ইনচার্জের নিকট হতে সংবাদ পেয়ে থানায় ছুটে আসেন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (মিরপুর জোন) জনাব মোঃ কামাল হোসেন স্যার বাদীর নিকট ঘটনা শুনে ঘটনাস্থলে অবস্থানরত এস আই তপন কুমার বিশ্বাসকে ফোন করে ঘটনার সত্যতা পেয়ে প্রয়োজনীয় নিদের্শনা প্রদান করেন। এস আই তপন কুমার বিশ্বাস ঘটনাস্থল থেকে সুরভিকে গ্রেফতার করেন। জব্দ করেন ফয়সাল সুরভির নগ্ন ছবি, ভিডিও সম্বলিত মোবাইল ফোন, স্বাক্ষর করা স্ট্যাম্প, যৌন কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন আলামত, ফাঁদে পড়া বিভিন্ন মানুষের স্বাক্ষর করা ব্যাংক চেক।আসামি ও জব্দ কৃত আলামতসহ এস আই তপন থানায় হাজির হলে শুরু হয় বকুল সাহের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক তদবির।
সকল তদবির উপেক্ষা করে বাদীর দেওয়া এজাহার আমলে নিয়ে নিয়মিত মামলা রুজু হয়। গ্রেফতারকৃত আসামী সুরভি বিজ্ঞ আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় দোষ শিকার করে সহযোগিদের নাম উল্লেখ করে জবানবন্দি প্রদান করে। সুরভির পলাতক সহযোগিদের গ্রেফতারের জন্য অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জনাব কামাল হোসেন স্যারের নেতৃত্বে মিরপুর থানা পুলিশের একাধিক চৌকস দল মাঠে কাজ করছে। মামলাটির তদন্তকালে জানা যায় বকুল(ছদ্মনাম) সুরভি সহ আরো একাধিক মেয়েদের দিয়ে প্রেমের ফাঁদে ফেলে মানুষকে জিম্মি করে টাকা আদায় করে আসছিলো।
বর্তমানে মামলাটি তদন্তধীন রয়েছে।
মেপ্র/এমএফআর