হটাৎ করেই সন্তানের কিছু কিছু আচরণগত পরিবর্তন আমরা মেনে নিতে পারি না।এতোদিনের বাধ্যগত বাচ্চাটি হয়তো কথা শুনতে চাচ্ছে না। সমস্যাটি শুরু হয় আচমকাই।প্রথম প্রথম হয়তো ব্যাপারটাকে সামান্য অবহেলা করি কিন্তু যতোই দিন গড়ায় সমস্যাটা অনেক প্রকট হতে দেখা দেয়। কারণ, নিজের সন্তানের সাথে বিশাল একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়। যেটা মেনে নেয়া মা-বাবার পক্ষে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠে। সেই সময়টা হচ্ছে কৈশোর বা টিনেজ ।
কৈশোর বা টিনএজ ( thirteen to nineteen ) হচ্ছে শিশুকাল আর বয়ঃপ্রাপ্তির অতি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। এই সময়ের হরমোন নিঃসরণ টিনএজারদের শরীরকে এবং মনকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করতে থাকে। এ সময় সব ধরনের হরমোনের কাজের দ্রুত এবং শক্তিশালী বিচরণ ঘটতে থাকে শরীরে, বস্তুত যার কাজ ঘটে চলে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে। আর এই কারনে সাময়িক অস্থিতিশীল বা ইমব্যালান্সান্ড আচরণ করতেই পারে শিশু সন্তান।
আমরা এই সময়টাতে শাসন করতে গিয়ে বলতেই পারি, ‘আমরা তো এই সময়টা পাড় হয়ে এসেছি, কিন্তু আমরা তো এমন ছিলাম না!’ কথাটি সত্য কিন্তু জেনারেশন গ্যাপ বলেও একটা কথা আছে -সেটা মানতে হবে আমাদের। সমস্যাটা যে দ্বিপাক্ষিক -আমরা সেটা বুঝতেও পারি না।কারণ, ঐ সময়ে কেবল শিশুটিই কৈশোরে পদার্পণ করে না, আমাদের মাতৃত্ব বা পিতৃত্বও কৈশোরে পদার্পণ করে। সন্তানের অবুঝ কিংবা উদ্ভট আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে আমরাও হয়তো এমন কিছু আচরণ করে ফেলি যা আমাদের সন্তানের কাছে উদ্ভট মনে হতে পারে এবং এই কারণেই দূরত্ব সৃষ্টি হয় কিংবা দূরত্ব আরো বেড়ে যায়।
কৈশোরে আচরণগত পরিবর্তন (সমস্যা):
১। দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনের কারণে কিশোর-কিশোরীরা কখনো লজ্জিত বা কখনো আনন্দিত থাকে, কখনো আক্রমণাত্মক, কখনো মনমরা হয়ে থাকে। আশঙ্কা, অনিশ্চয়তা , অন্তর্দ্বন্ধ এবং অসহায়বোধ এই বয়সের বৈশিষ্ট্য।
২। কোনো কোনো সময় মা-বাবা অথবা পরিবারের সদস্যদের বকাবকি ও নিপীড়নমূলক আচরণের কারণে তারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। হঠাৎ করে এরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
৩। মা-বাবা, শিক্ষক কিংবা গুরুজনের আদেশ-উপদেশকেও গ্রাহ্য করতে চায় না বরং চরম বিরক্তি প্রকাশ করে।
৪।একাকী ঘরে দরজা বন্ধ করে সময় কাটাতে চায়-সেটা বেডরুম হোক বা হোক বাথরুম। অর্থাৎ নিজের জন্য সে কিছু সময় চায়।
৫। ফ্যাশন সচেতন হয়ে ওঠে হঠাৎ করেই। অসচেতন হয়ে পরে পড়ালেখা সহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলোতে।
৬। হঠাৎ করে রেগে যায় সামান্য কিছুতেই, অল্পতেই মুড সুইং খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার তাদের জন্য।
৭। সুযোগ পেলেই নির্ঘুম রজনী কাটাতে চায় এবং এই অনিয়মটাকেই নিয়ম বানিয়ে ফেলতে চায়।
৮। ঠিকমতো খেতে চায় না। বিশেষ করে ঘরের খাবারের প্রতি অনীহা কাজ করে। বাইরের খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরে।
৯। কখনো কখনো হতাশা কাটাতে মাদকদ্রব্য, ফেসবুক, ইন্টারনেট ও পর্নো ছবিতে আসক্ত হয়ে পড়ে কোন কোন কিশোর কিশোরী।
১০। কিছু সংখ্যক কিশোর-কিশোরী আবার আবেগের বশে অনিরাপদ দৈহিক সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়তে পারে।
১১। অনিশ্চয়তা কাটাতে কোন কোন কিশোর -কিশোরী পেশী প্রদর্শণ করতে প্রলুব্ধ হয়। পরবর্তীতে যারা মস্তানী, নির্যাতন কিংবা হত্যার মতো অপরাধ ক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পরে।
১২। কারো কারো আচরণে আমূল পরিবর্তন আসা, অস্বাভাবিক রেগে যাওয়া, ধ্বংসাত্মক আচরণ, বন্ধুমহলে আমূল পরিবর্তন, পুরনো বন্ধুরা কোনো কারণে দূরে সরে যাচ্ছে, নতুন নতুন হঠাৎ বন্ধুর অন্তরঙ্গতা পরিলক্ষিত হয়।
১৩। কারো কারো স্কুল-কলেজে ঘণ্টা পালানো, বা প্রায়শই না যাওয়ার ব্যাপারটিও দেখা যায়।
১৪। ধর্মীয় ব্যাপারে অতিউৎসাহী মনোভাব কিংবা ঘরে সবার উপর তার বলপ্রয়োগের চেষ্টা দেখা যায়।
১৫। প্রায়শই হতাশাজনক কথাবার্তা বলা, আত্মহত্যা বা কারও প্রতি জিঘাংসার মনোভাব কারো কারো ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়।
১৬। সারাক্ষণ নিজের ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ করে থাকা, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দূরত্ব।
সমাধান:( মা-বাবার করণীয় ও সন্তানের করণীয়)
মা-বাবার করণীয়:
১। আপনার সন্তানকে সময় দিন। কর্মজীবী মা-বাবার জন্যে সময় বের করা কষ্টকর হলেও, সন্তানকে দেয়ার মতো একান্ত কিছু সময় বের করতেই হবে এবং তা নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে, যেমন, অন্তত রাতের খাবারে কিংবা ছুটির দিনগুলোতে একসাথে খাওয়ার সাথে সাথে প্রয়োজনীয় আলাপ সেরে নেয়া এবং বুঝিয়ে বলা যে, ওদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যই এই ব্যস্ততা ও ত্যাগ স্বীকার কর্মজীবী মা-বাবার।
২। আপনার সন্তানকে বুঝিয়ে বলুন যে, আপনার জীবনে সে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ , তার ভালো ও সৎ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠা তার নিজের জন্য এবং পরিবারের জন্য কতখানি জরুরী। সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য একজন আলোকিত দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা তার জন্য কতখানি যুক্তিযুক্ত। আপনার সন্তান যে অনন্য – এই আত্মবিশ্বাস তার মাঝে জাগিয়ে তুলুন।
৩। জীবনের বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপ ও এর স্বাভাবিক বৈশিষ্টগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে বুঝিয়ে বলা যে, বিশেষ করে টিনএজ বা কৈশোরে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের হঠাৎ ভারসাম্যহীনতায় বিব্রত বা অসহায় বোধ না করতে। পড়ালেখা ও জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিনিয়ত আপডেট করার সঠিক পন্থা আপনাকেই দেখাতে হবে, নয়তো সমাজ তাকে ভুলপথে পরিচালিত করতেই পারে।
৪। মা-বাবা যে সবসময় তাদের পাশে আছে-সেটা আচার আচরণ এবং সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে বোঝাতে হবে।আপনার সন্তানকে স্পেস দিন যাতে সে মনের ক্ষোভ, দুঃখ, হতাশা আর অসহায়ত্ব আপনার সাথে শেয়ার করতে পারে।
৫।সন্তানের নিরাপত্তার ব্যাপারে সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি দিন। বন্ধু কিংবা নিকটাত্মীয়ের বাসায় রাত্রিযাপনের অনুমতি দিবেন না কোনক্রমেই। নিজের ঘরেও প্রাইভেট টিউটর কিম্বা অতিথীদের যাতায়াত লিভিংরুম পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করুন। আর সেটা সম্ভব না হলে মনিটরিং করুন, সচেতন থাকুন।
৬। বাড়ির ছোট ছোট কাজগুলোতে সন্তানকে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করুন। নিজের কাজগুলোর প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তুলুন। সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই ‘এ কাজ শুধুই মেয়েদের’, ‘এ কাজ শুধুই ছেলেদের’– এভাবে বৈষম্যের শিক্ষা দেবেন না। পৃথিবীতে কোনো কাজই একান্ত মেয়েদের বা ছেলেদের নয়। পরিবারের ‘ভার’ নেওয়ার দায়িত্ব সবার সমান – আপনার কথা ও আচরণের মাধ্যমে আপনার সন্তানকে সেই শিক্ষা দিন।
৭। পড়াশোনায় সামর্থ নিয়ে পরিচিত কিম্বা সহপাঠীদের সঙ্গে তুলনায় এনে তার অর্জিত ফলাফল নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করে অযথা চাপ সৃষ্টি না করবেন না। মাছ যেমন আকাশে উড়তে পারে না , পাখিও তেমনি পানিতে বাস করতে পারে না। যথোপোযুক্ত পরিবেশেই প্রতিভা বিকশিত হয়। আপনি আপনার সন্তানকে সেই পরিবেশ দেয়ার চেষ্টা করুন।
৮। পারতপক্ষে সন্তানকে শারীরিক শাস্তি দিতে যাবেন না। তার গায়ে হাত তোলা যাবে না কোনভাবেই। এটা শুধুমাত্র নিষ্ঠুর অমানবিকতাই নয়, একটি শিশু বা কিশোরের জীবনে মানসিক দাগ রয়ে যাওয়ার মতো ক্ষত সৃষ্টি হয় এতে। তবে, প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে আপনাকে। দেয়ালে বেত ঝুলিয়ে রাখতে পারেন এবং বলতে পারেন , পরিবারের নিয়মবিধি ভাঙলে কতখানি শাস্তি প্রাপ্য, যেটা অন্যের হাতে নয় নিজহাতেই সেই শাস্তি প্রদানে আপনি কতোখানি কঠোরতা প্রদর্শণ করতে সক্ষম।
৯। আপনার সন্তান যদি নিজের কক্ষে অন্য কারও প্রবেশাধিকার একেবারে নিষিদ্ধ করে দেয়, তার ঘর থেকে সিগারেট, মাদক বা অন্য কোনো আসক্তির জিনিস সম্বন্ধে আপনার সন্দেহ হয় , সন্তানের মধ্যে সব সময় কিছু লুকোনোর প্রবণতা, মিথ্যা বলার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা, ঘরের অর্থ এবং মূল্যবান জিনিস চুরি যাওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পায়, তবে ইন্দ্রিয় সজাগ রাখুন। অন্যায়কে কোনভাবেই প্রশ্রয় দিবেন না। এই ক্ষেত্রে সন্তানের প্রতি আক্রমনাত্মক না হয়ে কুশলী হন। তাকে স্পেস দিন, খোলামেলা আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করুন এবং তার সমস্যা কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সাহায্য করুন। কারণ, সবকিছু ছাপিয়ে সে আপনারই সন্তান।
১০। সন্তানের সাথে সর্বদাই ইতিবাচক আচরন করবেন ও প্রশংসা করবেন।পরিবার বা নিজ বাসস্থান সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং মা-বাবা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক…
মেপ্র/এমএফআর