বাংলাদেশের চাকুরীর বাজার খুবই নাজুক অবস্থায় আছে, যেখানে ৪৭% শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বেকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে সারা দেশে ২৬ লাখ ৭৭ হাজার বেকার আছেন।
বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত “বাংলাদেশ স্কিলস ফর টুমরোস জবস” প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের কলেজগুলো থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা ৭০ শতাংশ বেকার থাকে। যেখানে পর্যাপ্ত চাকুরীর ক্ষেত্র তৈরি হয় না, সেখানে বিকল্প পেশা হিসাবে সম্মানজনক অবস্থায় আছে ফ্রিল্যান্সিং বা মুক্তপেশা।
ফ্রিল্যান্সিং খাতে বাংলাদেশ বেশ ভাল অবস্থানে আছে, বিশ্বে বাংলাদেশের দক্ষ পেশাদারদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে শত কোটি টাকার। হিসেব মতে বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সার আছে ৫ লক্ষাধিক।
ফ্রিল্যান্সিং কি?
ফ্রিল্যান্সিং মূলত একটি পেশার ধরণ। আমরা সাধারণত মনে করি দুই ধরণের পেশা, চাকুরী বা ব্যবসা। কিন্তু আরেক ধরণের পেশা আছে, যার নাম আমাদের জানা ছিল না, সাম্প্রতিক জনপ্রিয়তা পাওয়া পেশা। যেমন ইমারত নির্মাণকর্মী বা রাজমিস্ত্রির পেশাকে আপনি কি বলবেন? চাকুরী নাকি ব্যবসা? একই ভাবে রিক্সাচালক, ইলেক্ট্রিশিয়ান, নাপিত, ধোপা। যারা প্রোজেক্ট ভিত্তিক কাজ করে এর মধ্যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, সাংবাদিক, ঠিকাদার ইত্যাদি।
ফ্রিল্যান্সিং হল কোন প্রতিষ্ঠানে পার্মানেন্ট চুক্তিবদ্ধ না হয়ে বরং প্রোজেক্ট ভিত্তিক কাজ করা। ফ্রিল্যান্সিং করে আসছে মানুষ শত বছর ধরে। একটি রিক্সাচালকও ফ্রিল্যান্সার বা মুক্তপেশাজীবী। যাদের কাজের স্বাধীনতা আছে, ইচ্ছা হলে চালাবে, ইচ্ছা না হলে চালাবে না।
ফ্রিল্যান্সাররা মূলত কোন একটি কাজের উপরে বিশেষভাবে দক্ষতা অর্জন করে এবং এদেরকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মাসিক বেতন দিয়ে রাখা সম্ভব নয় বা কেউ রাখে না। যেমন নাপিত বা ডাক্তার বা উকিল, নাপিতকে বেতন দিয়ে না রেখে যখন লাগবে তাকে কাজে লাগানো এবং সেই মোতাবেক পরিশোধ করা ভাল।
ফ্রিল্যান্সারদের আয়ের পরিমানও বেশি। যেমন মেহেরপুরের একটি অটোরিক্সা চালক কমপক্ষে ২০-৩০ হাজার টাকা মাসিক আয় করেন, যেটা তাঁর যোগ্যতা এবং স্বাভাবিক বেতনের থেকে কয়েক গুণ বেশি। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ওয়েব ডেভেলপার বা ঠিকাদারের কথা নাই বা বললাম।
তাহলে আউটসোর্সিং কি?
মনে করেন আপনাকে আমঝুপি থেকে মেহেরপুরে যেতে হবে, নিজের পরিবহন নাই। আপনি রহিম নামের একজন রিক্সাচালককে ভাড়া করলেন। এখানে রহিম হল ফ্রিল্যান্সার, আর আপনার যেহেতু গাড়ি নাই, আপনি রহিমের সার্ভিসটি আউটসোর্স করলেন। মানে ক্লাইন্ট করে আউটসোর্সিং আর ফ্রিল্যান্সার করে ফ্রিল্যান্সিং।
ফ্রিল্যান্সার হতে কি কি লাগে?
ফ্রিল্যান্সারদের মূল বিনিয়োগ হচ্ছে তাঁদের দক্ষতা। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা ওয়েব ডেভেলপার বা গ্রাফিক ডিজাইনার বা মার্কেটিং এক্সপার্ট হতে হলে আপনাকে অবশ্যই দক্ষতা অর্জন করা পর্যন্ত ধৈর্যশীল হতে হবে। কাজ বুঝার বা কাজ করার মত ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। ফ্রিল্যান্সার হওয়া যেমন কঠিন, তেমন একজন সফল ফ্রিল্যান্সারের আয়ও কম নয়। কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্যশীল হওয়া, নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়া, শেখার ইচ্ছা প্রবল থাকা।
ফ্রিল্যান্সিং কিভাবে শিখবেন?
আমি মূলত অনলাইন প্রোফেশনাল হওয়া বা অনলাইনের কাজ গুলোর কথাই বলছি। কোন ভাবে ভেবে নেবেন না আমরা অনলাইনে কাজ করি, অনলাইন হল আমাদের শুধুই কাজ পাওয়ার মাধ্যম মাত্র।
মনে করেন আপনি একটি ইকমার্স ওয়েবসাইটে গিয়ে একটি টি-শার্টের অর্ডার দিলেন, ওনারা আপনাকে প্রোডাক্ট সুন্দরবন কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিল। এখানে ইকমার্স অনলাইনের মাধ্যমে একটি অর্ডার বা ক্লাইন্ট পেল, বাকি কাজ গুলো স্বাভাবিক। আমরাও অনলাইনের মধ্যে কাজ পায়, বাকি কাজ গুলো স্বাভাবিক ভাবেই করতে হয়।
আগে আপনি ঠিক করুন আপনার কি ধরণের কাজ করতে ভাল লাগে। যেমন ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং, অ্যাকাউন্টিং, এইচআরএম ইত্যাদি, প্রয়োজনের গুগলে সার্চ করে দেখে নিন কি কি কাজ অনলাইনে পাওয়া যায়। তার উপরে ভিত্তি করে আপনি স্থির করুন আপনি কোন কাজে ভাল বা আপনার জন্য কোন কাজটা ভাল হবে।
সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ বা সফল ফ্রিল্যান্সারের সাথে আলাপ করতে পারেন। নির্বাচিত বিষয় নিয়ে ইউটিউবে বা গুগলে সার্চ করুন। অনেক ইউটিউব চ্যানেল পাবেন যারা টিউটোরিয়াল দিচ্ছে বা অনেক ওয়েবসাইট আছে যারা অনলাইন কোর্স দিচ্ছে। যেমন ইশিখন, টেন মিনিট স্কুল ইত্যাদি।
মেহেরপুরে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আছে যারা ফ্রিল্যান্সিং ট্রেনিং দেয় এবং আমঝুপিতে অল্টারনেটিভ স্কুল নামের একটি প্রতিষ্ঠান আছে যারা ফ্রিল্যান্সিং ট্রেনিং দেয়। যারা ঢাকাতে আছেন বা অন্য জেলাতে আছেন খোঁজ নিয়ে দেখুন উক্ত এলাকাতে ট্রেনিং দেয় এমন প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে, না থাকলে অনলাইন কোর্স করুন।
যেহেতু অনেক কিছু শিখতে হয় আমি ব্যাক্তিগত ভাবে কোন এক্সপার্ট বা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথায় বলব। সঠিক দিক নির্দেশনা, মোটিভেশন এবং শাসন পাবেন। আর নতুনদের জন্য শুধু অনলাইন থেকে শিখতে বেশ কঠিন হতে পারে।
কাজ শিখে কাজ পাবেন কোথায়?
অনলাইনে এই জাতীয় কাজের অনেকগুলো ওয়েবসাইট বা মার্কেটপ্লেস আছে। যেখানে যে ক্লাইন্টের বা কোম্পানির কাজ আউটসোর্স করা লাগে, তাঁরা মার্কেটপ্লেস গুলোতে জব পোস্ট করে রেখে দেন এবং ফ্রিল্যান্সাররা উক্ত জবে এপ্লিকেশন করেন।
ক্লাইন্টের পছন্দ হলে ক্লাইন্ট আপনাকে হায়ার করবেন। কাজ করাবেন এবং উক্ত মার্কেটপ্লেসেই আপনাকে আপনার পারিশ্রমিক হিসাবে টাকা বা ডলার দিয়ে দেবেন।
উক্ত টাকা বা ডলার আপনি বাংলাদেশের যেকোনো ব্যাংকে উত্তোলন করতে পারবেন, আপনার নিজের ক্রেডিট কার্ড বা পেপ্যাল থাকা বাধ্যতামূলক না। আপওয়ার্ক, ফ্রিল্যান্সার ডট কম, ফাইবার, পিপল পার আওয়ার, গুরু, বাংলাদেশী বিল্যান্সার জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেস গুলোর অন্যতম।
আমি কেন ফ্রিল্যান্সিং পেশা বেছে নিলাম?
আমার ছোটবেলা থেকে আইটির প্রতি অনেক আগ্রহ ছিল। পারিবারিক চাপে বিবিএ এবং এমবিএ করলেও আইটিতে কিছু একটা করার প্রবল ইচ্ছা ছিল আমার।
২০০৯ সালের ঢাকা থাকাকালীন সময়ে আমি ফ্রিল্যান্সিং শুরু করি। ফ্রিল্যান্সিং ভাল লাগায়, কর্পোরেট চাকুরী ছেড়ে আমি ফ্রিল্যান্সিং-এই মন দেই, পরে ২০১০ সালে ঢাকা থেকে মেহেরপুরে চলে আসি। ফ্রিল্যান্সিং-এ স্বাধীনতা, স্বাভাবিক চাকুরীর থেকে বেশি আয়ের সুবিধা, নতুন কিছু করার সুবিধা, বিদেশি ক্লাইন্টদের বন্ধুত্বসুলভ আচরণের কারণে ফ্রিল্যান্সিংকে পেশা হিসাবে বেছে নেই।
ফ্রিল্যান্সিং-এ মেহেরপুর
পার্শ্ববর্তী জেলার থেকে মেহেরপুরের ফ্রিল্যান্সিং খাতটি খুবই নাজুক অবস্থানে আছে। আপওয়ার্ক মার্কেটপ্লেসে সার্চ করে দেখা যায়, ১০২ জন নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সার আছে, যার মধ্যে ১৭ জন ফ্রিল্যান্সার আয় করতে পেরেছে, ৬-৭ জন ফ্রিল্যান্সিংকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছেন।
ফ্রিল্যান্সার ডট কমে সার্চ করে দেখা যায় ৪৯৫ জন (কম-বেশি হতে পারে) ফ্রিল্যান্সার হিসাবে নিবন্ধন করেছেন কিন্তু আয় করতে পেরেছেন মাত্র ৩২ জন। যার মধ্যে ৭-৮ জন ক্যারিয়ার হিসাবে ফ্রিল্যান্সিংকে বেছে নিয়েছেন।
যেখানে অন্য পেশার থেকে স্বাধীনতা বেশি, চাকুরীজীবী বা ছাত্র বা গৃহিণীরাও ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন, এবং মেহেরপুরে যেহেতু পর্যাপ্ত চাকুরীর ক্ষেত্র নাই, সেখানে এই পরিসংখ্যান কোন ভাবেই আশার আলো দেখায় না। বাংলাদেশে অনেক জেলায় আছে যারা এই সুযোগ গুলোকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের এগিয়ে নিচ্ছেন, আয়ও করছেন বৈদেশিক মুদ্রা। মেহেরপুরে এই সম্ভাবনাময় খাতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে অনেক বেকারের কর্মসংস্থান করা সম্ভব।
লেখকঃ প্রধান নির্বাহী, ইউনিক সফটওয়ার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি- বাংলাদেশ