পরিবেশবান্ধব যানবাহনের প্রসার এবং কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) ব্যবহারের প্রতি বিশ্বব্যাপী আগ্রহ বাড়ছে। তবে এ চিত্র বাংলাদেশে ভিন্ন। এখানে ইভি বিক্রি বাড়ানোর প্রচেষ্টা নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে। উচ্চ নিবন্ধন ফি এবং আমদানি শুল্কের মতো আর্থিক বাধাগুলো এ সেক্টরের বিকাশে প্রধান অন্তরায়। দেশে ইভি বিপ্লবের পথে বাধা যেন সম্ভাবনার আকাশে মেঘের হাতছানি।
নিবন্ধন খরচে অস্বাভাবিকতা: বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) বৈদ্যুতিক গাড়ির নিবন্ধন ফি নির্ধারণে একটি অস্বাভাবিক পদ্ধতি অনুসরণ করছে বলে জানায় খাতসংশ্লিষ্টরা। প্রতি কিলোওয়াটকে ২০ সিসি ইঞ্জিন ক্ষমতার সমান ধরে নিবন্ধন খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে একটি ১৫০ কিলোওয়াটের বৈদ্যুতিক গাড়ির নিবন্ধন ফি বিলাসবহুল পেট্রোলচালিত গাড়ির সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া বৈদ্যুতিক গাড়ির মালিকদের বার্ষিক এক লাখ টাকা সারচার্জ দিতে হচ্ছে। এসব কারণে ইভি ক্রেতারা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
উচ্চ আমদানি শুল্ক ও এলসি বিধিনিষেধ
সম্পূর্ণ নির্মিত বৈদ্যুতিক গাড়ির (সিবিইউ) আমদানিতে বর্তমানে ৮৯ দশমিক এক শতাংশ শুল্ক আরোপিত হয়েছে। বৈদ্যুতিক গাড়ির আমদানিকারকরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) এ শুল্ক কমিয়ে ৩৭ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। পাশাপাশি, ডলার সংকটের কারণে এলসি মার্জিন বাড়িয়ে ১০০ শতাংশ করা হয়েছে, যা গাড়ি আমদানিকে আরও ব্যয়বহুল করে তুলেছে।
অবকাঠামোর অভাব : বাংলাদেশে ইভি (ইলেকট্রিক ভেহিকেল) বিকাশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে চার্জিং স্টেশনের অভাব। বর্তমানে, চার্জ ইজি ব্র্যান্ডের অধীনে দেশে মাত্র ১৮টি চার্জিং স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে, যা খুবই কম। বৈদ্যুতিক গাড়ির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি এবং পরিবেশবান্ধব পরিবহণব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। চার্জিং স্টেশনের পরিসর বৃদ্ধি এবং এ খাতে বিনিয়োগ না হলে, ইভি সিস্টেমের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সম্ভব নয়। তাই সরকারের সহায়তায় দ্রুত এ অবকাঠামো উন্নয়ন করা না গেলে ইভি পরিবহণব্যবস্থার ভবিষ্যৎ অন্ধকারেই থেকে যাবে।
ডিলার ও ক্রেতাদের হতাশা : বাংলাদেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির (ইভি) সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও উচ্চ নিবন্ধন ফি, শুল্ক এবং অগ্রিম আয়করের কারণে এ খাতে ডিলার ও ক্রেতারা হতাশা প্রকাশ করেছেন। সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি হওয়া সত্ত্বেও বাজার প্রসারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অতিরিক্ত খরচ। ডিলাররা মনে করছেন, নীতিমালা শিথিল না হলে ইভি বাজারের উন্নয়ন সম্ভব নয়। ‘ইভি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব হলেও ক্রেতারা নিবন্ধন খরচ ও অগ্রিম আয়করের উচ্চ ব্যয়ের কারণে আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে জানান দেশে ইলেকট্রিক গাড়ি বিক্রেতা একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তা।’
সমাধানের প্রস্তাব : বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজার সম্প্রসারণে ডিলাররা সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর কাছে সম্পূর্ণ বিল্ট-আপ (সিবিইউ) বৈদ্যুতিক গাড়ির আমদানি শুল্ক কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে। বর্তমানে ৮৯.১ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে ৩৭ শতাংশ করার সুপারিশ করা হয়েছে। ডিলাররা উল্লেখ করেছেন, প্রতিবেশী দেশগুলোতে বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজার চাঙা করতে চার্জ না নেওয়া বা ন্যূনতম ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমন উদ্যোগ নিলে গাড়ির বিক্রি বৃদ্ধি পাবে এবং সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়বে বলে তারা মনে করেন।ডিলারদের মতে, শুল্ক কমানোর পাশাপাশি এলসি মার্জিন বিধিনিষেধ শিথিল করলে বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। একইসঙ্গে চার্জিং স্টেশন বাড়ানো ও ক্রেতাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।
নতুন আশা: দেশে ইভির বাজার প্রসারে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে। জানা গেছে, পরিবেশের দিক বিবেচনায় বিআরটিএর পক্ষ থেকে নিবন্ধন খরচ কমাতে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) ৫০ শতাংশ কমানোর সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া বৈদ্যুতিক গাড়ির ওপর সারচার্জ কমানোর সুপারিশও করা হয়েছে এবং আশা করা হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ চার্জ মওকুফ করবে।
বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি শুরু হয়। ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ নিবন্ধিত ইভির সংখ্যা ৩০০-এর কাছাকাছি। তবে এ গতি ধরে রাখতে হলে নীতিমালায় পরিবর্তন ও সমর্থনমূলক অবকাঠামো জরুরি।
সূত্র: যুগান্তর