পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা উৎসব পালিত হয়। ২০১০ সাল থেকে ব্যতিক্রমধর্মী ‘বই উৎসব’ পালিত হয়ে আসছে বাংলাদেশে। এর পর থেকে কোভিড-১৯ বাদে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রতিবছর ১ জানুয়ারি নতুন শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎসব করে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের মাধ্যমে এ উৎসব পালন করা হয়।
হাতে গোনা কয়েকটি দেশে বিনামূল্যে বই দেওয়া হলেও বছরের শুরুতে বাংলাদেশে স্কুল পড়ুয়া সকল শিশুর হাতে নানা রঙের বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে, শিশুদের রঙিন চিত্রমালা শোভিত নতুন বই ঊর্ধ্বে তুলে ধরে, বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্যদিয়ে ‘বই উৎসব’ পালন পৃথিবীতে অনন্য। এ অভিনব উৎসব ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী প্রশংসা কুড়িয়েছে। এর পেছনে রয়েছে দেশের সব শিশু-কিশোরদের শিক্ষামুখী করা এবং তাতে উৎসাহিত করার বর্তমান সরকারের এক সুদূর প্রসারী চিন্তাভাবনা।
শিক্ষা শিশুর মৌলিক অধিকার। সুনিপুনভাবে এ অধিকার বাস্তবায়নে যথযথ প্রক্রিয়ায় শ্রেণিকার্যক্রম পরিচালনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ শিক্ষা কার্যক্রমের অন্যতম উপকরণ পাঠ্যবই বছরের শুরুতে পাওয়া নিয়ে এক সময় ছিল অনিশ্চয়তা।
বই বাজারে আসতে আসতে বছরের এক চতুর্থাংশ সময় চলে যেতো। তখন উচ্চতর শ্রেণির পরিচিত বা আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে পুরনো বই কিনে অথবা ধার নিয়ে পড়তে হতো। আবার অনেকেরই বই কেনার সামর্থ্য ছিল না। যাদের বই কেনার সামর্থ্য ছিল তাদের আবার নতুন বইয়ের সাথে না চাইলেও নোট বই কিনতে বাধ্য করা হতো।
এসব সীমাবদ্ধতা দূর করা ও শিক্ষাকে সকলের সামর্থের মধ্য নিয়ে আসার লক্ষ্য নিয়ে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার বিনামূল্যে স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বই বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি এটি প্রথম উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৩৪ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার কপি বই বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থীর জন্য অন্তত ৩৪ কোটি পাঠ্যবই বিতরণ করা হয়।
উল্লেখ্য যে, বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুরাও যাতে নিজ মাতৃভাষায় নির্বিঘ্নে প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে সেজন্য প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ২ লাখ ১২ হাজার ১৭৭টি বই বিতরণ করা হয়। এছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ছাপানো হয়েছে ব্রেইল বই। অপরদিকে মাধ্যমিক স্তরে (স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি) প্রায় ২৪ কোটি পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হয়।
বছরের প্রথম দিন শিশুদের হাতে বিনামূল্যে বই তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। উন্নত বিশ্বে যেটি সম্ভব হয়নি সে অভাবনীয় কৃতিত্বই দেখিয়েছে বাংলাদেশ। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এই উদ্যোগটি যে মহৎ এতে কোনো সন্দেহ নেই।
একটি পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে এ উদ্যোগের সফলতা সহজেই চোখে পড়বে। ১৯৯০ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুর শতকরা হার ছিল ৬১ ভাগ, বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে শতকরা ৯৭.৫৬ ভাগে। সরকারের অন্যান্য উদ্যোগের সাথে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ কার্যক্রম এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
নতুন শ্রেণির নতুন বই হাতে পেতে নতুন বছরের প্রথম দিনে যে বিপুল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে তার আনন্দ ও উৎসাহের কোন তুলনা হয় না।
কাজেই বিনা মূল্যে শিক্ষার্থীদের বই দেওয়ার ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সরকারের উচ্চ প্রশংসার দাবি রাখে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও যোগ্য নেতৃত্বের কারণেই বছরের শুরুর দিনে শহর থেকে গ্রাম—সর্বত্রই বই উৎসবের আমেজ, এ দৃশ্য ভালো লাগার, এ দৃশ্য ভালোবাসার।
এই অতুলনীয় কাজটি সরকার প্রতি বছরই বেশ সফলতার সঙ্গেই করছে। তবে একথাও সত্য পাঠ্যপুস্তক উৎসব তখনই সার্থক হবে যখন মানসম্মত শিক্ষার আলো পৌঁছে যাবে দেশের প্রতিটি ঘরে।
লেখক: চেয়ারম্যান, শিক্ষা বিভাগ ও ডিন, শিক্ষা বিজ্ঞান অনুষদ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।