২০১৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর নিখোঁজ হন কুষ্টিয়ার কুমারখালীর শহিদুল ইসলাম (৪৭) নামে এক গরু ব্যবসায়ী। পরদিন মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার চীবর গ্রামে একটি ফাঁকা জমিতে তার লাশ পায় পুলিশ। এ সময় লাশটি গলা ও দুই পায়ের রগ কাটা অবস্থায় পড়ে ছিল। তৎক্ষণাৎ পরিচয় জানতে না পেরে লাশটিকে অজ্ঞাত দেখিয়ে একটি মামলা করেন শ্রীপুরের ১ নম্বর গয়েশপুর ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশ নিরঞ্জন কুমার বিশ্বাস।
এ ঘটনার তিন বছর পর খুনের রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। অপহরণ মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ এই খুনের রহস্য উদঘাটন করেছে।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার ডিআইজি শেখ নাজমুল আলম বলেন, অপহরণ মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর গত ২২ নভেম্বর কুমারখালী থেকে রোজিনা বেগমকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে রোজিনা হত্যার কথা জানিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এখন আমরা আদালতে করা অপহরণ মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দেব এবং মাগুরার শ্রীপুর থানায় হওয়া হত্যা মামলাটি পুনর্জীবিত করার আবেদন করব।
জানা যায়, এক বছরের বেশি সময় ছেলের কোনো খোঁজ না পেয়ে শহিদুলের মা তমিরুন নেসা বাদী হয়ে কুষ্টিয়ার আদালতে একটি অপহরণ মামলা করেন। মামলায় শহিদুলের মৃত শ্যালক মোতাহারের স্ত্রী রোজিনা বেগম, তার বাবা জব্বার শেখ ও মা মতিরন নেসাকে আসামি করা হয়। আদালত ২০১৯ সালের ৫ মার্চ মামলাটি থানাকে নিয়মিত মামলা হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেয়। এরপর পুলিশ সদর দফতর ওই বছরের ৫ নভেম্বর অপহরণ মামলাটি সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেয়।
সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শহিদুলের শ্যালক মোতাহারের সঙ্গে রোজিনা বেগমের বিয়ে হয়। মোতাহারের ভালো ঘর না থাকায় সে বউ নিয়ে দুলাভাই শহিদুলের বাড়িতেই ছিলেন। এ সময় শ্যালকের বউয়ের প্রেমে পড়েন শহিদুল। বিষয়টি জানাজানি হলে মোতাহার তার স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা বাড়ি করে থাকা শুরু করেন। তবে এর কয়েক বছর পর মোতাহার মারা যান। এর মধ্যে শহিদুলের স্ত্রীও মারা যান। তখন শহিদুল শ্যালকের স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়মিত করার চেষ্টা করেন। তাকে বিয়েও করতে চান। তবে সম্পর্ক থাকলেও শহিদুলকে বিয়ে করতে রাজি হননি রোজিনা। এদিকে তার গ্রামে এই সম্পর্ক নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়।
পরবর্তীতে রোজিনা তার বাবার বাড়িতে চলে যান। তবে শহিদুলের সঙ্গে রোজিনার যোগাযোগ ছিল। কয়েকমাস পর রোজিনা ঢাকার মানিকগঞ্জে চলে আসেন। আকিজ গ্রুপে কাজ নেন। সেখানে মোমিন নামে একজনের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক হয়। মোমিনের গ্রামের বাড়ি মাগুরার শ্রীপুরে। তাকে বিয়ে করেন রোজিনা। তবে এরপরও শহিদুল তাকে ফোন করতেন। পরে মোমিন ও রোজিনা পরিকল্পনা করেন শহিদুলকে হত্যা করার। এরপর তারা দু’জন ঢাকা থেকে মাগুরার শ্রীপুরে চলে যান।
রোজিনা শহিদুলকে ফোন করে জানান, তিনি তাকে বিয়ে করবেন। ২০১৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর রাতে বিয়ের কথা বলে শ্রীপুরে নিয়ে যাওয়া হয় শহিদুলকে। শ্রীপুরের লাঙ্গলবাদ বাজার থেকে এক কেজি মিষ্টি কেনেন শহিদুল। ওই বাজারে আগে থেকেই শহিদুলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন রোজিনা ও মোমিন। তারা দু’জন শহিদুলকে একটি খোলা মাঠ থেকে হাঁটিয়ে নিয়ে যান।
দূরের আলো দেখিয়ে রোজিনা শহিদুলকে বলেন, ‘ওই বাতিজ্বলা বাড়িটি আমার বান্ধবীর, সেখানে যাব।’ এরপর খোলা মাঠের ভেতর দিয়ে তাকে নিয়ে যান। মাঠের কিছু দূর যাওয়ার পর রোজিনা ও মোমিন মিলে শহিদুলকে জাপটে ধরেন। প্রায় আধাঘণ্টা তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। এরপর শহিদুল ক্লান্ত হয়ে গেলে রোজিনা তার বুকের ওপরে উঠে বসে দুই হাত চেপে ধরেন। এক পর্যায়ে মোমিন চাকু দিয়ে গলায় একাধিকবার ছুরিকাঘাত করেন। মৃত্যু নিশ্চিত করতে তার হাত পায়ের রগ কেটে দেন মোমিন। ধস্তাধস্তির সময় চাকুর আঘাতে মোমিন ও রোজিনারও হাত কেটে যায়। তাই তারা বাড়িতে গিয়ে জানান, ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলেন।
পরের দিন শ্রীপুর থানা পুলিশ অজ্ঞাত হিসেবে শহিদুলের লাশ উদ্ধার করে। ধারণা করা হয়েছিল চরমপন্থিরা তাকে হত্যা করেছে। একটি হত্যা মামলা হলেও থানা পুলিশ তদন্তের কোনো কূলকিনারা না করতে পারায় হত্যা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। লাশ অজ্ঞাত হিসেবেই থাকে। কারণ ওই এলাকায় শহিদুলকে কেউ চিনতে পারেনি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সুজিত কুমার কর জানান, তিনি মামলা তদন্ত করতে গিয়ে প্রথমে শহিদুলের সর্বশেষ অবস্থান কোথায় ছিল তা শনাক্তের চেষ্টা করেন। প্রযুক্তির সাহায্যে তিনি জানতে পারেন, সর্বশেষ অবস্থান ছিল মাগুরার শ্রীপুরের লাঙ্গলবাদ বাজারে। রোজিনারও অবস্থান ছিল একই এলাকায়। এরপর তারা রোজিনাকে ঢাকার আশুলিয়া থেকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। পরবর্তীতে তার দেওয়া তথ্যে গত ৭ ডিসেম্বর নরসিংদীর মাধবদী উপজেলা থেকে মোমিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনিও হত্যার কথা স্বীকার করেছেন।