মেরিন একাডেমী চট্টগ্রামে একটি কথা প্রচলিত আছে মেরিনার্স ডেয়ার টু গো হোয়ার ডেথ ফেয়ারস টু গো। অর্থাৎ মেরিনাররা মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে পৃথিবীতে যে কোন প্রান্তে সাহসিকতার সাথে যেতে সক্ষম। আমি জাহাজ নিয়ে গত ৩১ শে অক্টোবর ২০২৪ তারিখে তাইওয়ান এর একটি পোর্ট কাউশিউং এ সুপার টাইফুন কং-রে এর কবলে পড়েছিলাম। অর্থাৎ টাইফুনটি আমাদের খুব কাছে দিয়েই পার হয়ে গিয়েছিল।
টাইফুন বা ঘূর্ণিঝড়টি উত্তর পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্টি হয়ে ফিলিপাইনের কোস্ট ঘেসে তাইওয়ানের ইস্ট কোস্টে আঘাত হানে এবং তারপর কিছুটা দুর্বল হয়ে চায়নার সাংহাই এর দিকে চলে যায়। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে এখন অনেক আগে থেকেই জাহাজের ইনমারসেট,ওয়েদার ফ্যাক্স, নেভটেক্স,ইমেইলর মাধ্যমে সার্বক্ষণিক ওয়েদার ফোরকাস্ট, নেভিগেশনাল ওয়ার্নিং ছাড়াও সকল ধরনের সতর্কবাণী পাওয়া যায়। এছাড়াও জাহাজ কোম্পানির মেরিন ডিপার্টমেন্ট থেকে ওয়েদার ইনফরমেশন, ওয়ার্নিং, সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়ের লাইভ ইমেজ পাঠানো হয় জাহাজকে সতর্ক করার জন্য।
সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেই আমরা জাহাজকে সব সময় নিরাপদে রাখার চেষ্টা করি। লোডিং পোর্ট ব্রাজিল এর সান্তোস থেকে আমরা দ্বীপ রাষ্ট্র তাইওয়ান এর জন্য খাদ্য কর্ন নিয়ে এসেছিলাম। আমরা প্রায় ৭০ হাজার মেট্রিক টন কর্ন কার্গো নিয়ে এসেছিলাম তাইওয়ানের দুইটি বন্দর কাউশিয়ং এবং তাইচুং এর জন্য। আমরা যথারীতি প্রথম বন্দর কাউশিয়ং এ যাই কারগো ডিসচার্জ করার জন্য। ৩০ অক্টোবর ২০২৪ এর বিকেলে কিছু কারগো ডিসচার্জ করার পর বন্দর থেকে কারগো অপারেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমরা ওয়েদার রিপোর্ট এর মাধ্যমে আগে থেকেই জানতাম টাইফুন কং-রে তাইওয়ানে আঘাত হানতে চলেছে। তাই অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য বন্দর থেকে আমাদের জাহাজ সহ বাকি সব জাহাজ বার্থ বা জেটি থেকে বের করে দেওয়া হয়। আমরা সার্বক্ষণিক জাহাজ থেকে ওয়েদার রিপোর্ট চেক করতে থাকি এবং পোর্ট অথরিটি, লোকাল এজেন্ট, চার্টারার এবং কোম্পানির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করি। আমরা প্রায় এক সপ্তাহ পূর্বেই জেনেছিলাম টাইফুনটি তাইওয়ানে আঘাত হানতে পারে। বর্তমানে ওয়েদার ফোরকাস্ট এর কল্যাণে অনেক আগে থেকেই জাহাজে সতর্কবাণী পাওয়া যায়। বন্দর এর নির্দেশ মতো আমরা জাহাজ আনমুরিং করে আউটার হারবারে ড্রিফটিং করতে চলে যাই।
বার্থ বা জেটিতে থাকা অবস্থাতেই আমরা টাইফুন এর জন্য সব রকম প্রিপারেশন নিয়ে রাখি। সবকিছু সিকিউর করে তারপরেই আমরা আউটার হারবারের দিকে রওনা হই। আউটার হারবারে আমরা জাহাজের ইঞ্জিন দিয়ে ব্যাড ওয়েদার মেনুভারিং করতে থাকি। বাতাস এবং ঢেউকে সামনে রেখে জাহাজ চালাতে থাকি বিপদজনক অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য। রাতে ধীরে ধীরে বাতাস এবং ঢেউ বাড়তে থাকে। আমরাও সার্বক্ষণিক বাতাস এবং ঢেউ পর্যবেক্ষণ করতে থাকি এবং সেভাবেই জাহাজের হেডিং এডজাস্ট করতে থাকি যাতে জাহাজে খুব বেশি রোলিং পিচিং না হয়। আমরা সকলেই সুপার টাইফুন টিকে নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলাম যেহেতু টাইফুন টি খুব শক্তিশালী ছিল।
ডেক এবং ইঞ্জিন ডিপার্টমেন্ট থেকেও যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছিল। নির্ঘুম কেটেছিল আমাদের সমস্ত নাবিকের রাতটি। এই অবস্থায় জাহাজের ক্যাপ্টেন এর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাহাজের সকল নাবিকের মনোবল ধরে রেখে সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে জাহাজ কে নিরাপদে রাখা এ সময় ক্যাপ্টেন এর প্রধান দায়িত্ব। কোম্পানির অফিস জাপান থেকেও আমাদের কাছে সতর্কবার্তা দিয়েছিল যাতে আমরা কোন নিরাপদ জায়গায় অবস্থান করি। আমরা একটু পরপরই কোম্পানির কাছে আমাদের অবস্থান জানিয়েছিলাম। ৩১শে অক্টোবর ২০২৪ খুব সকালে থেকেই লক্ষ্য করলাম বাতাস আস্তে আস্তে আরো বেড়ে গেল। বাতাসের গতি ৬০/৭০ নটস বা ঘন্টায় ১১১/১২৯ কিলোমিটার এবং সেই সাথে ঢেউ এর উচ্চতা প্রায় ৭/৮ মিটার হয়ে গেল। জাহাজের স্টিয়ারিং এবং ইঞ্জিন দিয়ে নিরাপদ অবস্থানে থাকার চেষ্টা করলাম। আমাদের মত অনেক জাহাজই এভাবে ব্যাড ওয়েদার মেনুভারিং এ ছিল সে সময়।
সুপার টাইফুন টি ৩১ শে অক্টোবর দুপুরেই তাইওয়ানের ইস্ট কোস্টে ঘন্টায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে। আমরা তাইওয়ানের ওয়েস্ট কোষ্ট এ ছিলাম এবং টাইফুন টি আমাদের থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার দূর দিয়ে পার হয়ে যায়। জানা যায় গত ৫০ বছরের মধ্যে এটি ছিল তাইওয়ান এ আঘাত হানা সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড়। এরফলে বেশ কিছু হতাহতের খবর পাওয়া গিয়েছিল। এছাড়াও বিদ্যুৎবিহীন ছিল সেখানকার কয়েক লক্ষ মানুষ। প্রাণ হানি এড়াতে সেখানকার সরকার টাইফুন আসার পূর্বেই সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিল। তাইওয়ান এর সিভিল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে জানানো হয়েছিল প্রায় ৩০০ টিরও বেশি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। সুপার টাইফুন কং-রে তাইওয়ানের পূর্ব উপকূলে আঘাত হেনে আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে যায় এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। পূর্বাঞ্চলের কোন কোন জায়গায় আকস্মিক বন্যা এবং ভূমিধসের সৃষ্টি হয়েছিল। টাইফুনটি কিছুটা উত্তর দিকে যেয়ে দিক পরিবর্তন করে চায়নার সাংহাই এর দিকে চলে যায়। এক সময় সমুদ্রের অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে যায় এবং আমরা জাহাজে ইনেস্পেকশন করি।
মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে এবং সকল নাবিকের একাগ্রচেষ্টায় এবং সহযোগিতায় আমরা বিপদ হতে মুক্ত হই। জাহাজ, নাবিক এবং লোডেড কার্গোর কোন ক্ষয়ক্ষতি ঘটেনি। যদিও একদিনের অধিক সময় আমাদের খুব উৎকণ্ঠায় কেটেছিল। আমার সী ক্যারিয়ারে এটি ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ের মুখোমুখি হয়েছি যার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এক্ষেত্রেও আমরা নিরাপদে উৎকণ্ঠার সময়গুলো পার করেছি।
সমুদ্রে বাতাসের গতি এবং ঢেউ স্বাভাবিক হয়ে গেলে আমরা পোর্ট কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগ করি এবং তারা কনফার্ম করলে আমরা আবারো বন্দরের ভিতরে প্রবেশ করি এবং বাকি কারগো ডিসচার্জ করে পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হই।
লেখক: মাস্টার মেরিনার (এ এফ এন আই), এক্স ক্যাডেট, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি চট্টগ্রাম।