মেহেরপুরে গম, ভুট্টা, তামাক ও আলুর আবাদের ভরা মৌসুমে সার নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন কৃষকেরা। এক বস্তা সার সংগ্রহ করতেই চাষিদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। সার মিললেও বস্তাপ্রতি ক্ষেত্রবিশেষে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা।
এদিকে ডিলারদের দাবি, একই কৃষক তাদের বিভিন্ন আত্মীয়ের নামে বার বার সার তুলছেন। যার ফলে সার দিতে একটু সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
মেহেরপুরের বিভিন্ন গ্রামের সার ডিলারদের গুদামের সামনে সারের জন্য আইডি কার্ড হাতে কৃষকদের দীর্ঘ লাইন। কখন মিলবে সার এমন প্রতিক্ষায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে কৃষক ও কৃষাণিরা। কেউ সার নিয়ে ফিরছেন বাড়ি, আবার অনেকেই ফিরছেন খালি হাতে। কৃষকদের অভিযোগ ডিলার ও সাব ডিলারদের অনিয়মের কারণে এবং ডিলাররা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বেশি দামে সার বিক্রির কারণে সারের এমন কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে বলেও চাষিরা অভিযোগ তুলেছেন।
তবে কৃষি বিভাগ বলছে, সারের কোনো সংকট নেই। কারখানায় সার উৎপাদনে কিছুটা দেরি হওয়ায় এমন সমস্যা হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মেহেরপুর জেলার তিনটি উপজেলায় বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশন (বিসিআইসি) কর্তৃক অনুমোদিত সার ডিলার রয়েছেন ৩৫ জন এবং বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (বিএডিসি) কর্তৃক অনুমোদিত সার ডিলার রয়েছেন ৬৮ জন। এসব ডিলারদের মধ্যে সদর উপজেলায় ১৩ জন, মুজিবনগর উপজেলায় ১০ জন এবং গাংনী উপজেলায় ১২ জন ডিলার রয়েছেন। এদের সঙ্গে কৃষকদের সারের সংকট কাটাতে শুধুমাত্র গাংনী উপজেলাতে বিএডিসি এবং বিসিআইসির সাব ডিলার রয়েছেন ১৫৪ জন। এসব ডিলার ও সাব ডিলাররা প্রতিবছর সার বরাদ্দ পান। জেলা কৃষি সম্প্রসারণের তথ্যে জানা গেছে, টিএসপি ১৫ হাজার ২৯৯ টন, ইউরিয়া ৩ হাজার ৬৩৭ টন, ডিএপি ১৪ হাজার ৮৬১ টন এবং পটাশ ১২ হাজার ৯৩৯ টন সার বরাদ্দ পান।
তবে ডিসেম্বর মাসের চাহিদায় টিএসপি ১ হাজার ৭৮১ টন, ডিএিপ ২ হাজার ৪৪২ টন, ইউরিয়া ৪ হাজার ৯৬৪ টন এবং পটাশিয়াম ২ হাজার ৮২৪ টন সার পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে চলতি মাসের (ডিসেম্বর) সব সারই তুলেছেন সংশ্লিষ্ট ডিলাররা। ৫০ কেজির এক বস্তা টিএসপি সারের সরকারি মুল্য ১৩৫০ টাকা। ডিএপি ১০৫০ টাকা, এমওপি ১০০০ টাকা এবং ইউরিয়া ১৩৫০ টাকা।
কিন্তু ডিলারদের নিকট থেকে প্রয়োজন মোতাবেক সার না পেয়ে কৃষকদের বিভিন্ন দেকান থেকে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে।
গাংনী উপজেলার কয়েকটি ডিলারদের গুদামের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কয়েকশ মানুষ সারের জন্য অপেক্ষা করছে। বেশ কয়েকজন কৃষক অভিযোগে বলেন, আমরা দুদিন সার কিনতে এসে ফিরে গেছি। অনেক মানুষের লাইন। আজকে পাব কি না তা জানি না।
একই ব্যক্তিকে বিসিআইসি ও বিএডিসি ডিলার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যার ফলে ডিলাররা দুই স্থান থেকে উত্তোলনকৃত সার দিচ্ছেন। লোকবল সংকটের কারনে সার দিতে দেরী হওয়ার কথা জানান কৃষকরা।
কৃষকরা জানান, একই ব্যক্তিকে দুই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স না দিয়ে পৃথক পৃথক ব্যক্তিকে ডিলার নিয়োগ করা হলে আমরা তাড়াতাড়ি সার পেতাম।
শুধু তাই নয়, মেহেরপুর গাংনী শহরের সার ব্যবসায়ী বিএডিসি ডিলার তরিকুল ইসলামের দোকানে সার ক্রয় করতে গিয়েও সার না পেয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে অনেক কৃষককে। এছাড়া জেলা কৃষক লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক শহিদুল ইসলাম শাহ তার নিজের নামে বিএডিসি ও বিসিআইসি থেকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ৪টি ডিলার নিয়োগ নিয়ে গাংনী উপজেলার চাষিদের মাঝে সার বিক্রয় করছেন।
এদিকে বিসিআইসি ডিলার সমিতির মেহেরপুর জেলা সভাপতি হাফিজুর রহমান হাপির রয়েছে হক এন্টারপ্রাইজ, সম্রাট এন্টারপ্রাইজ ও আকছেদ এন্টারপ্রাইজ নামে ৩টি ডিলারশিপ। পৃথক নামে হলেও সবই পরিচালনা করেন হাফিজুর রহমান।
গাংনীর ষোলটাকা গ্রামের কৃষক ছামিদুল ইসলাম বলেন, ষোলটাকা ইউনিয়নের বিসিআইসি সার ডিলার গাংনী হাসপাতাল বাজারে ব্যবসা করে থাকে ইউনিয়নে তার কোন সারের ব্যবসা নেই।
বানিয়াপুকুর গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে আকবর জানান, ইউনিয়নে কোনো সার ডিলার না থাকায় ১০ কেজি সারের প্রয়োজন হলেও বাজারে সার কিনতে যেতে হয়।
বিসিআইসির সাব ডিলার তেরাইল গ্রামের আব্দুর রহিম বলেন, ডিসেম্বর মাসের বরাদ্দ প্রতি মাসে ১৩৮ ইউরিয়া, ৫৬ ডিএপি, ফসফেট ৪৯ বস্তা, পটাশ ৩০ বস্তা। এমন বরাদ্দকৃত সারে কৃষকের চাহিদা পূরুণ হচ্ছে না।
খুচরা ডিলার সভাপতি মো. শাহিনুল ইসলাম শাহিন বলেন, ১৪ মাস খুচরা ডিলাররা সার পায় না। তিনবার জেলা প্রশাসকের বরাবর আবেদন করেও কোনো প্রতিকার পাইনি। খুচরা ব্যবসায়ীদের সার দিলে এমন সমস্যা তৈরী হতোনা।
সাধার সম্পাদক মোমতাজ উদ্দিন বলেন, বিসিআইসির ডিলাররা আমাদের সার দেয়নি প্রায় এক বছর। আমাদের মাধ্যমে সার দিলে কোন কৃষকের সারের অভাব হবে না।
বিসিআইসি ডিলার সমিতির মেহেরপুর জেলা সভাপতি হাফিজুর রহমান হাপি বলেন, কৃষকদের সার দেওয়ায় নিয়ে কোনো অনিয়ম হচ্ছে না। কৃষকরা একটু ধৈর্য্য ধরলে সবাই সার পাবেন। তিনি আরও বলেন, আমাদের অনিচ্ছা থাকা সত্বেও দুই প্রতিষ্ঠান থেকে ডিলারশীপ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিবছর তামাক কোম্পানিগুলো প্রণোদনা হিসেবে সার দিত তামাক চাষিদের।এবার সার না দিয়ে নগদ টাকা দিয়েতে তাই সারের প্রয়োনীয়তা বেড়ে গেছে।
মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালদার বলেন, জেলায় চাহিদা অনুযায়ী সার পাচ্ছি। মেহেরপুর জেলায় প্রতিবছর এসময় কৃষকরা আলু,তামাক,তুলা,গম,ভুট্রার আবাদ করেন। যার ফলে সারের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে গেছে। এছাড়া সার কারখানায় সার উৎপাদনেও কিছুটা ধীরগতি। তবে শিঘ্রই সমস্যা কেটে যাবে।