জেলা প্রশাসকের বাংলোতে হুকুম শোনার কাজে নিয়োজিত হন বছর বিশেক আগে। পরবর্তিতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পিয়ন পদে নিয়োগ পান তিনি। নিয়োগের ৫ বছর পর সুযোগ পান ট্রেজারি শাখায়। আর এই সুযোগকে ফাল হিসেবে কাজে লাগিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন।
তিনি হলেন ডিসি অফিসের পিয়ন সুফল হোসেন। বর্তমানে মেহেরপুর সদর উপজেলার বুড়িপোতা ভূমি অফিসে অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। সুফল হোসেন মেহেরপুর সদর উপজেলার চকশ্যামনগর গ্রামের কালু মন্ডলের ছেলে।
বিশ্বস্ত ও একাধিক সূত্রে জানা গেছে, জাল ষ্ট্যাম্পের ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন তিনি। পরিবারে অভাব-অনটনের কারণে জীবনের শুরুতে কষ্টের মধ্যে দিনযাপন করলেও বর্তমানে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক। ভূমি অফিসে পিয়ন পদে চাকরি করলেও রাজকীয় জীবনযাপন তার। মেহেরপুর কোর্ট এলাকায় একটি বহুতল ভবনে ভাড়ায় বসবাস করেন তিনি। ঘর ভর্তি দামী দামী আসবাবপত্র। মিনারেল ওয়াটার ছাড়া ব্যবহার করেন না।
সুফল হোসেন ২০ বছর আগে জেলা প্রশাসকের বাসায় কাজ করার জন্য নিয়োজিত হন। প্রায় দশ বছর পর পরবর্তী জেলা প্রশাসকের দয়ায় ২০০৫ সালে পিয়ন পদে চাকুরী পায়। চাকুরী পাওয়ার ৫ বছর পরে ট্রেজারি অফিসে বদলি হয়ে আসে। ট্রেজারি শাখায় দীর্ঘ প্রায় ৮ বছর কাজ করার পর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ট্রেজারি অফিসে থাকার সুবাদে জাল স্ট্যাম্প বিক্রির এক ব্যবসায়ীর সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। এসময় সুফল হোসেন কয়েকজন কে স্ট্যাম্প বিক্রির লাইসেন্স করে দিয়ে গড়ে তোলেন জাল স্ট্যাম্প বিক্রির একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের মূলহোতা সম্প্রতি জাল স্বাক্ষর করা ১৩ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকার স্ট্যাম্প কান্ডের রফিকুল ইসলাম এর হাতে মিলিয়ে করছেন কোটি কোটি টাকার ব্যবসা।
শুরু হয় জাল স্ট্যাম্পের রমরমা ব্যবসা। ট্রেজারি অফিসের ভেন্ডাররা স্ট্যাম্প তোলার দিন আসল স্ট্যাম্পের সাথে জাল স্ট্যাম্প ক্রয় করে নিয়ে যান। দিনে দিনে হতে থাকেন আঙুল ফুলে কলাগাছ। বনে যান কোটি কোটি টাকার মালিক। দীর্ঘদিন ধরে ট্রেজারি অফিসে চাকরির সুবাদে জাল স্ট্যাম্পের জমজমাট ব্যবসা ফাদিয়েছিলেন। যা অফিসপাড়ায় বিষয়টি অনেকেই জানে। সুফল হোসেন অত্যন্ত ধূর্ত ও চালক। কৌশল খাটিয়ে নিজের নামে টাকা ও সম্পদ না রেখে ভাইদের নামে রাখে। তাছাড়া নামে-বেনামে আরও অনেক কিছু আছে যা সুষ্ঠ তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
অনুসন্ধানে তার সম্পতির যে বিবরণ পাওয়া গেছে তা রীতিমতো বিস্ময়কর। অনুসন্ধানে জানা যায়, মেহেরপুর ঘোষপাড়ায় রাজা বিড়ি কোম্পানির নিকট থেকে ক্রয় করা প্রায় দুই কোটি টাকার জমি । তার নিজ গ্রামে দশ বিঘা জমি ক্রয় করেছে যার আনুমানিক মূল্য এক কোটি টাকা। একটি দশ চাকার ট্রাক আছে। শহরের মাদ্রাসা পাড়ায় তার নিজ নামে ৫ কাঠা জায়গা আছে যার বাজার মূল্যে ৪০ লক্ষ টাকা। পুলিশ সুপারের বাসভবনের সামনে ৪ কাঠা জমি যার আনুমানিক মূল্য এক কোটি টাকা। বড় ভাই নজরুল ইসলাম দু’বছর আগেও মাঠে ছাগল চরাতেন কিন্তু বর্তমানে তিনি শহরের পন্ডের ঘাট এলাকায় প্লাইউড এন্ড পারটেক্স গ্যালারী সুবিশাল দোকান এর মালিক। ওই এলাকায় জনৈক নাটক মিয়ার মার্কেটে প্লাইউড এন্ড পারটেক্স গ্যালারী একটি গোডাউন ভাড়া নেওয়া আছে।
চকশ্যামনগর গ্রামের একাধিক বাসিন্দারা বলেন, আসলেই সুফলদের পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। যা আলাদিনের গল্পকেও হার মানিয়েছে। সুফলের বড় ভাই নজরুল প্রায় দশ বারো লাখ টাকা খরচ করে পুলিশের ভেতরে ছেলের চাকরি নিয়ে দিয়েছে। দেড় দু’বছর আগেও নজরুল মাঠে ছাগল চরানোর কাজ করতো। দশ চাকার ট্রাকও আছে সুফলের ছোট ভাই চালায়। নজরুল তোমাদের মেহেরপুর দোকান দিয়েছে। আগে ওই দোকানে আলগামনে মালপত্র আসতো এখন আসে ট্রাকে। হঠাৎ এত পরিবর্তন আমাদের মাথায় আসে না বাপ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুফল বলেন, কোর্ট পাড়ায় আমার জমি আছে চার কাঠা। তাছাড়া যেসকল জমিজমার কথা বলছেন সেগুলো সব আমার ভাই ভাবিদের। হঠাৎ এত টাকা কোথায় পেলেন এর উৎস কোথা থেকে জানতে চাইলে তিনি প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলেন আমার নামে কোন অভিযোগ থাকলে আমার কর্তৃপক্ষ ডিসি স্যার কে জানান। আমার কর্তৃপক্ষ আমাকে হাজির করবে তখন কান টানলে মাথা আসবে। আপনি আমার অফিসে এসেছেন সরাসরি আপনি আমার কাছে আসবেন আমিতো বাঘ ও না ভাল্লুক ও না। আপনিও মানুষ আমিও মানুষ।
আমদহ ইউনিয়ন পরিষদের ৫নম্বর ওয়ার্ড সদস্য ও চকশ্যামনগর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল কুদ্দুস জানান, ডিসি অফিসের পিয়ন সুফলতো গ্রামে আসেই না। একজন পিয়ন হয়ে কিভাবে এত টাকার সম্পদ হলো তা যে কারো বিবেককে প্রশ্ন করলেই উত্তর পাবে। তার এসকল সম্পদের উৎস কি তা তদন্ত করার দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে মেহেরপুর জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ মনসুর আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, আমি এখানে মাত্র ৮-৯ মাস আগে এসেছি। অতীতে কি হয়েছে আমার জানা নেই। যা শুনেছি সবই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। তবে এই সমস্ত কালপ্রিটের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হওয়া উচিত। নির্দেশ পেলে সব খতিয়ে দেখব।