মিয়ানমার এখন সেনা সরকারের পুরো কবজায়। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের প্রথম দিনেই ক্ষমতাচ্যুত অং সান সু চির সরকারের অধিকাংশ সদস্যকে বরখাস্ত করে নতুন লোক নিয়োগ করেছে। দুই দিন পেরিয়ে গেলেও মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি ও প্রেসিডেন্ট উয়িন মিন্টসহ কাকে কোথায় কীভাবে রাখা হয়েছে তা প্রকাশ হয়নি।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, মিয়ানমারের রাস্তাঘাটে খুব একটা বেশি পরিবর্তন চোখে পড়ে না। সোমবারের সেনা অভ্যুত্থানের পর গতকাল পর্যন্ত মিয়ানমারে বড় ধরনের কোনো বিক্ষোভ হয়নি। পার্থক্য বলতে রাস্তায় রয়েছে অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী। তবে সকালে এক ট্যাক্সিচালক এএফপিকে বলেন, আমরা বিক্ষোভ করতে চাই। কিন্তু আমাদের মা (সু চি) তাঁদের হাতে। আমরা খুব বেশি কিছু করতে পারি না।
আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থাগুলোর খবর, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের প্রথম দিনেই সু চি সরকারের ২৪ জন মন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছে। সেই সঙ্গে নতুন ১১ জন মন্ত্রী নিয়োগ করেছে। নতুনদের বেশির ভাগই সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা। কয়েকজন রয়েছেন সেনা সমর্থিত দল ইউএসডিপির সদস্য। ইউএসপিডির অন্যতম নেতা উনা মং লউনকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে।
জানা গেছে, তিনি নভেম্বরের নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। সেনাবাহিনী পরিচালিত টেলিভিশনে নতুন এসব নিয়োগের ঘোষণা দেওয়া হয়। সোমবার ভোরে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট উয়িন মিন্ট, ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সান সু চিসহ কয়েকজন মন্ত্রীকে আটক করার পর দেশজুড়ে এক বছরের জরুরি অবস্থা জারি করেছে সেনাবাহিনী। এ দিন ভোরের আলো ফোটার আগেই সু চি ও মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট উয়িন মিন্টকে নেপিদো থেকে আটক করে সেনাবাহিনী। এরপর থেকে সু চিকে কোথায় রাখা হয়েছে, বিষয়টি স্পষ্ট করেনি সেনাবাহিনী। তবে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটির সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের এক দিন পর মঙ্গলবার অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) আটক নেতাদের দ্রুত মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
মিয়ানমারের পত্রিকা মিয়ানমার টাইমস জানিয়েছে, মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানে আটক অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) মান্দালয়ের আঞ্চলিক কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ এখন সেনাবাহিনী ও পুলিশের হাতে। পুলিশ কার্যালয়টি বন্ধ করে দিয়েছে। কার্যালয়ে অবস্থান করা দলের নেতা-কর্মীদের বের করে দিয়ে এর নিয়ন্ত্রণ নেয় পুলিশ। পুলিশ ওই এলাকায় চলাচল সীমিত করে দিয়েছে এবং পরে কার্যালয়ের ভিতরে তল্লাশি চালায়। এনএলডির তথ্য কমিটির এক সদস্যের বরাত দিয়ে মিয়ানমার টাইমস জানায়, মান্দালয়ের মুখ্যমন্ত্রী এখন গৃহবন্দী আছেন এবং সাগাইংয়ের মুখ্যমন্ত্রী ইউ মিন্ট নাইংকে হুলতাউ চত্বরে রাখা হয়েছে। মান্দালয়ের আঞ্চলিক সরকার ও মান্দালয় সিটি ডেভেলপমেন্ট কমিটির কার্যালয় এখন সেনাবাহিনী ও পুলিশের কয়েকটি ব্যাটালিয়নের নিয়ন্ত্রণে।
এ ছাড়া, মন্ত্রিসভার মন্ত্রীদের আবাসিক ভবনের নিয়ন্ত্রণও এখন তাদের হাতে। আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের পার্লামেন্টের শত শত আইনপ্রণেতাকে দেশটির রাজধানী নেপিদোতে ‘খোলা জায়গায় বন্দীশিবিরে’ রেখেছে সেনা শাসকরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আইনপ্রণেতা বলেছেন, তাদেরকে যেখানে রাখা হয়েছে সেই কম্পাউন্ডটি ‘খোলা জায়গায় বন্দীশিবির’। তিনি আরও বলেছেন, আমি খুবই উদ্বিগ্ন। আমাদেরকে বাইরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। পার্লামেন্টের প্রায় ৪০০ সদস্যের সঙ্গে তিনি নেপিদোতে একটি সরকারি হাউজিং কমপ্লেক্সে রয়েছেন। সেখানে তারা একে অপরের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা টেলিফোনে নিজেদের এলাকায় কথা বলেছেন উল্লেখ করে তিনি আরও জানিয়েছেন, তবে কাউকে কম্পাউন্ডের বাইরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না।
তিনি বলেছেন, কমপ্লেক্সের ভিতরে পুলিশ ও বাইরে সেনা সদস্যরা টহল দিচ্ছে। অং সান সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ও অন্যান্য ছোট ছোট দলের নেতারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে গত রাতটি নির্ঘুম কাটিয়েছেন বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। এনএলডির এক আইনপ্রণেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, ‘শুনেছি, তাদেরকে (সু চি ও মিন্ট) নেপিদোতে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। তাদেরকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই বলে আমাদের জানানো হয়েছে। তারপরও আমরা তাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা বাসায় রয়েছেন এর ছবি যদি দেখানো হতো তাহলে আমরা অনেকটা নিশ্চিত হতে পারতাম।’
এক দিন পর খুলে দেওয়া হলো মিয়ানমারের ব্যাংক : মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের এক দিন পর দেশটির ব্যাংকগুলো খুলেছে। তবে এখনো বন্ধ রয়েছে শেয়ারবাজারের কার্যক্রম। সোমবার নেটওয়ার্ক দুর্বল জানিয়ে আর্থিক সেবা বন্ধ করে দেয় মিয়ানমার ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন। পরে তারা একটি বিবৃতিতে জানায়, মঙ্গলবার ব্যাংক খোলা। অং সান সু চিকে আটকের পর থেকে দেশটির ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিছু কিছু জায়গায় টেলিফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ব্যাংক, পুঁজিবাজারের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। দেশব্যাপী দোকানপাটও নির্দিষ্ট সময়ের আগে বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য সব কিছুর কারণ হিসেবে নেটওয়ার্ক ত্রুটির কথা বলা হয়। তবে এখনো শেয়ারবাজারের কার্যক্রম বন্ধ আছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বসছে নিরাপত্তা পরিষদ : মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের ফলে দেশটিতে এখনো থাকা ৬ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানের দুর্দশা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে ভয় পাচ্ছে জাতিসংঘ। মিয়ানমারের অভ্যুত্থান নিয়ে মঙ্গলবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠক হওয়ার কথা। তার আগের দিন জাতিসংঘের মুখপাত্র মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গাদের নিয়ে এ উদ্বেগ জানালেন। জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক বলেছেন, এখনো ৬ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইনে আছে, যাদের মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার বিভিন্ন শিবিরে আটকা।
তারা স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারছে না; স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ন্যূনতম সুযোগ থেকেও বঞ্চিত। আমাদের ভয় হচ্ছে, এ ঘটনা (অভ্যুত্থান) তাদের পরিস্থিতি আরও খারাপ করে দিতে পারে। মঙ্গলবার মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে রুদ্ধদ্বার আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কূটনীতিকরা। যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত বারবারা উডওয়াড বলেছেন, আমরা সেখানে শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি হুমকি নিয়ে কথা বলতে চাই; এ বিষয়ে অবশ্যই মিয়ানমারের এশিয়া ও আসিয়ান প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে।
২০১৭ সালে রাখাইনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা পরিষদ যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করেছিল রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে চীন সেসব আটকে দেয়। সোমবার জাতিসংঘের চীন দূতাবাস জানিয়েছে, মঙ্গলবার নিরাপত্তা পরিষদের ব্রিফিংয়ে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও অনেক কিছুই জানা যাবে বলে তারা আশা করছে। জাতিসংঘে চীন মিশনের এক মুখপাত্র বলেছেন, আমরা আরও আশা করছি যে, পরিষদ এমন পদক্ষেপই নেবে যা মিয়ানমারের পরিস্থিতিকে আরও জটিল না করে সেখানকার স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক হবে।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে : মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে আগামী এক বছরের জন্য জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা।
এই ঘটনায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অবস্থানরত লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মতে, সেনা অভ্যুত্থানের ফলে রাখাইন রাজ্যে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। তাদের দুর্দশা আরও অনেকাংশে বেড়ে যাবে। সূত্র : দ্য স্ট্রেইটস টাইমস।
এ বিষয়ে জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টেফানে দুযারিক বলেছেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এখনো ৬ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার ক্যাম্পে বন্দী অবস্থায় আছেন। তারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না। মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় তাদের সুযোগ খুবই সীমিত। আমরা শঙ্কা করছি, দেশটির নতুন এই সেনা অভ্যুত্থান সেখানে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটাবে।