সেলাই মেশিনে দারিদ্র্যতাকে জয় করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন গাংনীর হিজলবাড়িয়া গ্রামের সেলিনা খাতুন। একইসঙ্গে ভূমিকা রাখছেন সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে নিয়ে তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে। নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি অসহায় নারীদের দিচ্ছেন বিনা মূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণ। সেলিনার এই ইতিবাচক রুপান্তরে প্রধান ভূমিকা রেখেছে দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর দক্ষতাবৃদ্ধিমুলক প্রশিক্ষণ, যে প্রশিক্ষণ থেকে তিনি পেয়েছেন আত্মকর্মসংস্থানে যুক্ত হবার সুযোগ।
কাজ না পাওয়া প্রবাসী স্বামী ও এক কন্যা সন্তানকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করলেও বর্তমানে এলাকাবাসীর কাছে এক মহীয়সী নারীর নাম সেলিনা। দারিদ্র্যকে জয় করে ইতিমধ্যে সমাজের নারী জাগরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সেলিনা খাতুন।
সেলিনা খাতুন মেহেরপুরের গাংনী উপজেধীন কাথুলী ইউনিয়নের রাধাগোবিন্দপুর গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের তাহাজ উদ্দিন ও রেহেনা খাতুনের ৫ সন্তানের ২ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ কন্যা।
বাবা কৃষি কাজ আর মা গৃহিনীর কাজ করতেন। লেখাপড়া শুরু হয় গ্রামের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিকের পাঠ শেষ করে মাধ্যমিকে পদার্পন করেন।মাধ্যমিকে ৭ম শ্রেণীতে পড়াবস্থায় তার পরিবারের পক্ষ হতে বিয়ে দিয়ে দেয়।
সাহারবাটি ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ড হিজলবাড়িয়া গ্রামের আজিজুল ও রাহেলা খাতুনের দ্বিতীয় ছেলে সাইদুল ইসলামের সাথে ২০০৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তার বিয়ে হয়। বিয়ের ৩ বছর পর ২০০৮ সালে কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে কন্যা সন্তান। সংসারে এমনিতেই অভাব তারউপর আবার বাড়তি সদস্য কোনরকম টেনেটুনে সংসার চলত তাদের। সেলিনা খাতুন স্বামীর ও বাবার সাথে যুক্তিপরামর্শ করে ২০১৪ সালে স্বামীকে বিদেশ পাঠান ধারদেনা করে। একদিকে ঋনের বোঝা অন্যদিকে বিদেশে স্বামীর কাজ না পাওয়া অপরদিকে শ্বশুর থেকে আলাদা সব মিলিয়ে ছোট মেয়েকে নিয়ে মহাসংকটময় দিনযাপন করতো সেলিনা।
এমতাবস্থায় ২০১৫ সালে দি হাঙ্গার প্রজেক্টের সহযোগিতায় স্থানীয় জিজিএসের আয়োজনে দক্ষতাবৃদ্ধিমুলক ২ মাস “সেলাই” প্রশিক্ষণ নেন।সেলাইয়ের কাজ করে মাসে প্রায় ৩ হতে ৪ হাজার টাকা আয় হয়। যা দিয়ে মোটামুটি সংসারের খরচ চলতো। এরপর পাশাপাশি সবজি চাষ শুরু করেন বাড়ির আঙিনায়। কয়েক বছরেই হয়ে ওঠেন স্বাবলম্বী। তার দেখাদেখি গ্রামের আরও অসহায় নারীরা সেলিনার কাছে আশে। তাদেরও বিনা মূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলেন। বর্তমানে সেলিনা প্রতি মাসে ৮-১০ হাজার টাকা উপার্জন করেন। সেই সাথে প্রবাসী স্বামীর উপার্জন শুরু হওয়াতে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করছে সেলিনার পরিবার।
তিনি নিজের হাতে ৩ টি জিজিএস গঠন করেছেন এবং ৩ টির সাথেই যুক্ত আছেন। একটির সভাপতি এবং অন্য ২ টির সাধারণ সদস্য হিসেবে আছেন।সেলিনা বর্তমানে বাল্যবিবাহ, যৌতুক ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নিয়মিত উঠান বৈঠকের আয়োজন করেন। এছাড়াও বিবাহ ও জন্মনিবন্ধন নিশ্চিতকরণ, প্রসূতি মা ও শিশুর টিকা, মা ও শিশুর পুষ্টি, গর্ভবতী নারী ও নবজাতক শিশুর ওজন পরীক্ষা,ঝরে পড়া শিশুদের পুনরায় বিদ্যালয়গামীকরণ, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা স্থাপন, বৃক্ষরোপন,আত্বকর্মসংস্থান সৃষ্টি,স্থানীয় সংগঠন তৈরি -সহ বিভিন্ন বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে নিয়মিত সভা ও উঠান বৈঠক করেন।
এ বিষয়ে সেলিনা খাতুন বলেন, এই কাজের সাথে যুক্ত হবার আগে আমার ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম সম্পর্কে ধারনা ছিলনা কি কি সেবা আছে তাও জানতাম না। এসব কিছু সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা লাভ করেছি এই জিজিএসের সাথে যুক্ত হয়ে।তাছাড়া স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও মত প্রকাশের অধিকার সম্পর্কে আরো বেশি সচেতন হই। পরিবারকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, আমিও পরিবারের অর্থ যোগানের এক হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারি। সমাজের মানুষের জন্য কাজ করতে পারি। এখন আর কেউ বাঁধা দেয় না, সবাই উৎসাহ দেয়। মেয়েকে গাংনী সন্ধানী স্কুল এ্যান্ড কলেজে ভর্তি করেছি। মেয়ে সাদিয়া এখন ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। আমার বিয়ে হয়েছিল ১৩ বছর বয়সে। আমি বুঝেছি বাল্যবিয়ে হলে একজন নারীর কত ক্ষতি হয়।
আর তাই আমার মেয়ে সাদিয়াকে সর্বোচ্চ লেখাপড়া এবং নিজ পায়ে না দাড়ানো পর্যন্ত বিয়ে দেবনা এটা আমার প্রতিজ্ঞা। শুধু তাই নয়, আমি সমাজকে বুঝিয়ে দিতে চায় নারীরাও পারে সংসারের হাল, সমাজের হাল, রাষ্ট্রের হাল ধরতে।তিনি বলেন, “শোন হে নারী তুমি দিতে পারো পুরুষের ন্যায় সবপথে পাড়ি, তোমাকে সৃষ্টা করেনি সৃষ্টি হতে পুরুষের দাসী।”