আমরা যাঁরা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে তত্ত্বের আশ্রয় নিয়ে থাকি তাঁরা বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও তত্ত্বের বাইরে গিয়ে এড়াতে পারি না। বিশেষত বিভিন্ন সময়ে সাহিত্য সমালোচনার খাতিরে ‘উপনিবেশবাদ’, ‘উত্তর-উপনিবেশবাদ’, ‘নয়া উপনিবেশবাদ’ ইত্যাদি তত্ত্বের প্রয়োগ চোখে পড়ে। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি শক্তির যে প্রভাব, সেটি নিয়ে কারো ‘নয়া ঔপনিবেশিক’ কোনো বিশ্লেষণ চোখে পড়ছে না। বিষয়টি ভাবায় একারণে, নিকট অতীতেও যাঁরা বাংলাদেশে ‘সাম্রাজ্যবাদ’, ‘হেজিমনি’ ইত্যাদি নিয়ে সরব ছিলেন তাঁরাও বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশি শক্তির প্রভাব নিয়ে সেরকম দৃষ্টিভঙ্গিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্যত্র বক্তব্য দিচ্ছেন না।
শুরুতে বলা প্রয়োজন, বর্তমান রাজনীতিতে বিদেশি শক্তির প্রভাব সৃষ্টি-প্রয়াসের ধরন নিয়ে। পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসার আহ্বান জানান। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন প্রক্রিয়ার আহবান জানিয়েছেন।
অন্যদিকে, গত ৩১শে অক্টোবর ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারা কুক বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলের সাথে। সেখান ব্রিটিশ হাইকমিশনার অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টির উপর জোর দিয়েছেন। এভাবেই সম্প্রতি বিদেশি শক্তি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করে চলেছে। তাদের কথাবার্তা এবং ভূমিকা নিরপেক্ষ মনে হচ্ছে না। তাদের অভিপ্রায়ে একটি দলের ‘মুখপাত্রের’ ভূমিকা পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেকারণে বিদেশি শক্তির এমন ভূমিকাকে যথেষ্ট সন্দেহের চোখেই দেখবার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিদেশি শক্তির এমন প্রভাবকে কর্তৃত্ববাদী আচরণ হিসেবেই তাত্ত্বিকভাবে উপস্থাপন করা যায়। যাকে বলা যায় ‘নয়া উপনিবেশ’। সেই সূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান আচরণে নয়া উপনিবেশের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য, ‘রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ’ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে কি তাদের উদ্দেশ্য জোর করে অন্য কাউকে ক্ষমতায় বসানো, যাতে পরবর্তীকালে এদের সহায়তায় বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়, যেটি আওয়ামী লীগ সরকার করতে দিতে রাজি নয়?
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা পুরোপুরি কলোনিয়াল বা নয়া ঔপনিবেশিক লক্ষণাক্রান্ত। বিএনপির সভা-সমাবেশ বা কর্মসূচির ধরন দেখে এটি পরিস্কার, দলটি চায় যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা। নির্বাচন তাদের কাছে কোন বিষয় নয়। নির্বাচন যদি সুষ্ঠুও হয় আর তাতে যদি আওয়ামী লীগ জয় লাভ করে তাতেও তারা নির্বাচনকে সুষ্ঠু বলবে না। বরং বিদেশি শক্তির প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় যাওয়াই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একারণে, নিজেদের দল গোছানো, সংলাপে সাড়াদান এসবে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। নির্বাচনের সময় এলেই দলটির ক্ষমতার কথা মনে পড়ে, সংবিধান মেনে নির্বাচন হওয়াটা তাদের কাছে বড় বিষয় নয়।
দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এটা স্পষ্ট, বিএনপি চায় ‘ক্ষমতা’, আর তারা মনে করছে বিদেশি শক্তি তাদের মুখে তুলে খাইয়ে দিবে তা। কিন্তু বিদেশি শক্তির ভূমিকাকে এত সরল করে দেখার সুযোগ নেই। সেকারণেই তারা অনধিকার চর্চায় নানা বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। ঘোলা জলে মাছ শিকারের অপেক্ষায় আছে। বাংলাদেশ যতই বলুক, ‘বাংলাদেশ কোন রাষ্ট্রের সাথেই বৈরিতা চায় না, সবার সাথেই বন্ধুত্ব চায়।’ তাতে বিদেশি শক্তির কিছু এসে যায় না। নয়া উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা যাদের লক্ষ্য তারা বিএনপিকে ব্যবহার করে দেশে ‘ডলার সাম্রাজ্যবাদ’ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। ক্ষমতার মোহে অন্ধ যারা তারা এখন এটি বুঝবে না। ব্যবহৃত হওয়ার পর বুঝেও লাভ নেই। কারণ, জনগনের শক্তিকে না জাগিয়ে বিদেশ ভক্তি যারা করে তাদের কপালে বাংলাদেশের ক্ষমতা কখনো জুটবে বলে মনে হয় না। আমার কাছে মনে হয়, এরা দেশই বুঝে না এবং সময়ের ভাষা বুঝতে পারার মধ্যে নেই! যেকোনো রাজনৈতিক দলের জন্য এটি বড় ব্যর্থতা!
‘শর্তহীনভাবে সংবিধানের মধ্যে থেকে আলোচনায় রাজি থাকলে সংলাপে যেতে আপত্তি নেই আওয়ামী লীগের।’—আওয়ামী লীগকে এই যৌক্তিক দাবির বাইরে নেয়ার মত সামর্থ্য বিএনপির আপাতত নেই। থাকলে নিজ দেশের জনগণের ওপর নির্ভর করত তারা। বিদেশি ভুয়া উপদেষ্টার জন্ম দিয়ে, বিদেশি শক্তির ওপর ভর করে নয়া উপনিবেশের নব্য রাজাকারের ভূমিকায় দলটি যেতে চাইত না। বর্তমানে বিদেশি শক্তির চাওয়া আর বিএনপির চাওয়ার মধ্যে পার্থক্য করা যাচ্ছে না।
কাজেই আওয়ামী লীগ যেভাবে বিদেশি শক্তির প্রভাব উপেক্ষা করেই নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছে সেটি আসলে নয়া উপনিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। নিজ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষারও লড়াই। অন্যদিকে নব্য রাজাকারের দল ও দোসর এদেশের সংবিধান মানবে সে প্রত্যাশা কেউই করে না। বর্তমানে যে দলগুলো বিদেশি শক্তিকে সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক নয় সেই দলগুলোই নির্বাচনে আসবে। বিদেশি শক্তি কি একে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলবে? নিজ স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে কখনোই বলবে না। ফলে বিদেশি শক্তির প্রভাব এড়াতে সংবিধান মেনেই নির্বাচন হওয়া উচিত। আশাকরি, আওয়ামী লীগ বিদেশি শক্তির কাছে নতি স্বীকার করবে না।
রাশিয়া, চীন কিংবা ভারত, তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র নয়া উপনিবেশের মানসিকতা থেকেই এটি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস তাই উপনিবেশের শৃঙ্খল হাতে ছুটে চলেছেন!
বাংলাদেশের স্থিতিশীল রাজনীতিতে বিদেশি শক্তি তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য যে প্রভাব সৃষ্টি করতে চাইছে তা রুখে দিতে এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী মুক্তিকামী প্রতিটি মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।