১৯৯৯ সালে প্রাক–সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার মাধ্যমে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সূত্রপাত হয়। ২০০৫ সালে সমীক্ষা শেষে পরের বছর ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশগত প্রভাব মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়।
এর মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পের একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করে এতে মোট ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা।
২০০৫ সালের ১৯ অক্টোবর ডিপিপি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। তবে তখনকার সরকার ডিপিপি অনুমোদন করে যেতে পারেনি। এরপর বিশদ নকশা প্রণয়নে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে ২০০৭ সালে দরপত্র আহ্বান করেন তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওই বছর আগস্টে পদ্মা সেতু নির্মাণে একটি ডিপিপি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায়। এতে ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। ডিপিপিতে ২০১৫ সালের মধ্যে সেতু নির্মাণের লক্ষ্য ঠিক করা হয়।
২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২২ দিনের মাথায় পদ্মা সেতুর পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরির জন্য নিউজিল্যান্ডভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মনসেল এইকমকে নিয়োগ দেওয়া হয়। শুরুতে সেতু প্রকল্পে রেল চলাচলের সুবিধা ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেল সুবিধা যুক্ত করে চূড়ান্ত নকশা প্রণয়নের নির্দেশনা দেন। এর মধ্যেই সরকার জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়।
২০১০ সালের মধ্যে নকশা চূড়ান্ত হওয়ায় পরের বছর জানুয়ারিতে ডিপিপি সংশোধন করা হয়। সংশোধনীতে প্রথমবারের মতো প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করে সেতু বিভাগ। এর মধ্যে সেতুর দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি অন্যতম। শুরুতে মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার। পরে তা বৃদ্ধি করে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার করা হয়। প্রথম ডিপিপিতে সেতুর ৪১টি স্প্যানের মধ্যে তিনটির নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা রেখে নকশা করা হয়েছিল। পরে ৩৭টি স্প্যানের নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের সুযোগ রাখার বিষয়টি যুক্ত করা হয়। প্রথম সংশোধিত ডিপিপিতে বেশি ভার বহনের ক্ষমতাসম্পন্ন রেল সংযোগ যুক্ত করা হয়। কংক্রিটের বদলে ইস্পাত বা স্টিলের অবকাঠামো যুক্ত হয়। সেতু নির্মাণে পাইলিংয়ের ক্ষেত্রেও বাড়তি গভীরতা ধরা হয়। বাড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন ব্যয়ও।
নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ঋণচুক্তি সই করে সরকার। কিন্তু নির্মাণকাজের তদারক করতে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। এরপর একে একে সব অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিশ্রুত অর্থায়ন স্থগিত ঘোষণা করেন।
২০১২ সালের ৯ জুলাই মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবশ্য ২০১৪ সালে তদন্ত শেষে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়ে দেয়, দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০১৭ সালে কানাডার টরন্টোর এক আদালত জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত প্রমাণ পাননি তাঁরা।
২০১৬, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে আরও তিন দফা ডিপিপি সংশোধন করা হয়। এর মধ্যে ২০১৬ সালের সংশোধনীতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত সেই ব্যয়ের পরিমাণই বহাল আছে।
২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতু নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর।
এরপর প্রথমবার ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিয়ারের ওপর বসানো হয় ‘৭ এ’ স্প্যানটি। এটি বসানো হয় সেতুর জাজিরা প্রান্তে। সর্বশেষ ৪১ নম্বর স্প্যান (স্প্যান ২-এফ) বসে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ওপর। এর মাধ্যমে দৃশ্যমান হয় সেতুর পুরো ৬ হাজার ১৫০ মিটার। আর প্রায় সূচনার দুই দশক পর আগামী ২৫ জুন চালু হতে যাচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
সূত্র: বাংলা নিউজ ২৪