নানা রঙের কাগজ ও সামিয়ানা দিয়ে সাজানো হয়েছে বাড়ি। চলছে নাচ-গান। প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনে ভর্তি বাড়িতে যেন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। বর-কনেকে সাজানো হয়েছে বিয়ের পোষাকে। তবে এখানে কোনো মানুষের বিয়ে হচ্ছেনা; দুটো গাছকে দেওয়া হচ্ছে বিয়ে!
ঘটা করে ব্যতিক্রমী এমন বিয়ে হয়েছে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার ডাউকি ইউনিয়নের বিনোদপুর গ্রামে। ওই গ্রামের দরগাতলা পাড়ার নবীছউদ্দীন বিশ্বাসের স্ত্রী মোমেনা খাতুনের স্বপ্নপূরণ করতেই এই বিয়ের অনুষ্ঠান।
মোমেনা খাতুন বলেন, ‘‘এক বছর আগে স্বপ্নে আমাকে ওই দু’টো গাছকে বিয়ে দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাই গাছ দু’টোর বিয়ে দিয়ে আমার স্বপ্নপূরণ করলাম।”
গত সপ্তাহের মঙ্গলবার দুপুর থেকে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মোমেনা বেগমের স্বপ্নপূরণ। প্রথম দিন হয় গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। ওই দিন তার বাড়ির আঙিনার বট ও অশ্বথ (পাকুর) গাছকে প্রথমে হলুদ মাখানো হয়। এরপর তাদের গোসল করানো হয়। পরদিন হয় ক্ষীর খাওয়ানো অনুষ্ঠান। গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুরু হয় বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা।
সকাল ১১টা থেকে শুরু হয় বিয়ের আয়োজন। বট গাছকে পুরুষ ও পাকুর গাছকে নারী রূপে ধরা হয়। গাছের চারপাশ রঙিন কাগজ ও ফুল দিয়ে সাজানো হয়। টানানো হয় সামিয়ানা। বট গাছে জড়ানো হয় লুঙ্গি, আর পাকুর গাছে শাড়ি। ধুপ, আগরবাতি ও মোমবাতি জ্বালানো হয়। গাছের গোড়ায় রাখা হয় বিভিন্ন ফল।
গাছ দুটোকে বিয়ে পড়িয়েছেন একই গ্রামের মানোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘আমি একটি ব্যতিক্রর্মী বিয়ে পড়ালাম। বিয়েতে সব ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। কিছু নিয়ম কানুন মেনে বিয়ে পড়িয়েছি।”
অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য গত শুক্রবার একটি খাসি জবাই করা হয়। সকাল থেকে শুরু হয় রান্নার আয়োজন। দুপুরের আগেই শেষ হয় রান্না। বিয়েতে আত্মীয় স্বজন ও গ্রামের শতাধিক নারী-পুরুষকে দাওয়াত দেওয়া হয়।
দুপুরে শতাধিক নারী-পুরুষদের খাবার দেওয়া হয়। অতিথিদের খাওয়ানো হয় খাসির মাংস, সাদা ভাত, মুসুর ডাল, সবজি ও মুরগির মাংস।
বিয়ের দাওয়াত খেতে আসা বিনোদপুর গ্রামের বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন খোকন বলেন, ‘‘আমি একজন বাঁশি বাদক। অনেক জায়গায় অনুষ্ঠানে গিয়েছি, কিন্তু এমন বিয়ে প্রথম দেখলাম। মোমেনা খালা বিয়ের দাওয়াত দিয়েছিল। গ্রামের সবাই মিলে বিয়ের দাওয়াত খেয়েছি।’’
জরিনা খাতুন নামে এক বৃদ্ধা বলেন, ‘‘বয়স অনেক হলেও এমন বিয়ের কখনও দেখিনি। শখ করে বিয়ের আয়োজন করেছে তারা। অনুষ্ঠান দেখে খুব ভাল লেগেছে।’’
আরো পড়ুন: মুজিবনগরে বিয়ের দাবিতে প্রেমিকের বাড়িতে প্রেমিকার অনশন
বিয়ের আয়োজক মোমেনা খাতুন জানান, স্বপ্নে তাকে যখন বিয়ে দিতে নির্দেশ দেওয়া হয় তখন তার আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। তাই তখন কিছুই করতে পারেননি। তবে কয়েকদিন পর তার স্বামীও একই স্বপ্ন দেখেন বলে দাবি করেন তিনি।
মোমেনা জানান, এরপর বিষয়টি পরিবার ও প্রতিবেশীদের জানানো হলে তখন সবাই আলোচনা করে বিয়ের দিন ঠিক করা হয়। বিয়ের আয়োজনের জন্য টাকাও তোলা হয়। বিয়ের জন্য সকল কেনা কাটা করা হয়। ছেলে-মেয়ের শাড়ি, লুঙ্গি, সাজ সজ্জার উপকরণ, বাজারসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা হয়।
তিনি আরও জানান, ‘‘বাড়ির পাশে একটি খেজুর গাছ ছিল। সেই খেজুর গাছের মধ্যে বট ও পাকুর গাছ জন্ম নেয়। পরে খেজুর গাছটি মারা যায়।’’
আলমডাঙ্গা সরকারি ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কৃষিবিদ গোলাম সরোয়ার বলেন, ‘‘এ ধরনের বিয়ের আয়োজনের কথা প্রথম শুনলাম। গ্রামের মানুষ কুসংস্কার থেকে এ ধরনের আয়োজন করেছে।’’
আলমডাঙ্গা উপজেলার জামজামি গ্রামের মাওলানা নাসির উদ্দিন বলেন, ‘‘ধর্মের ওপর বিশ্বাস না থাকার কারণে এ বিয়ের আয়োজন করেছে। ইসলাম ধর্মে যার কোনো বিধান নেই। কুসংস্কার থেকে এমনটি হয়েছে।’’
আলমডাঙ্গা ডাউকি ইউনিয়ানের ৩নং ওয়ার্ডের মেম্বার বদর উদ্দিন জানান, প্রথমে আমি মনে করি নবীছদ্দিন বিশ্বাসের নাতির বিয়ে হচ্ছে। কারণ বাড়িতে গান বাজনা, আনন্দ দেখে মনে হচ্ছিল বড় আয়োজন করে বিয়ে হচ্ছে। পরে জানতে পারি বট ও পাকুর গাছের বিয়ে হয়েছে।
-এ.এইচ কামরুল, চুয়াডাঙ্গা