বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে প্রায় ৫০ বছর আগে, প্রস্তুতি চলছে স্বাধীনাতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা যুদ্ধাক্রান্ত জনগষ্ঠী একটি কালের সাক্ষী, ইতিহাসের সাক্ষী, লড়াইয়ের সাক্ষী। কোটি কোটি মানুষের নির্যাতিত হওয়ার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা অনুসন্ধান ও লিপিবদ্ধ করে প্রকাশনার মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দলিত কন্ঠ এই বিষটির গুরুত্ব বিবেচনা করেই “স্বাধীতা সংগ্রাম ও দলিত জনগোষ্ঠী” শিরনামে একটি অনুসন্ধানি প্রতিবেদন তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা অত্যন্ত প্রসংশনীয় উদ্যোগ।
মেহেরপুরের দলিত জনগোষ্ঠী স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় কেমন ছিলেন, কি করেছেন, যুদ্ধে কোনো অবদান রেখেছিলেন কি না-নানান বিষয় নিয়ে কথা হয় সেই সময়ের প্রত্যক্ষ করা প্রবীণ দলিতদের সাথে।
মেহেরপুর শহর সংলগ্ন গ্রাম গভীপুরে বসবাস করেন অশিত কুমার বিশ্বাস (৮৩), বিশ্বনাথ কর্মকার (৭০), মুক্তিনাথ বিশ্বাস (৭৩), রঞ্জিত কুমার দাস (৭৪), বিদ্যুৎ কুমার দাস (৬৭), সমির কুমার বিশ্বাস (৬৫), পরেশ বিশ্বাস (৮৫), শহরে বসবাসরত বাশরী মোহন দাস (৬৬) এবং গাংনী উপজেলার শিমুল তলা গ্রামের নীলমনি গোস্বামী (৭১) সহ কথা হয় অনেকের সাথে।
৭১ সালে অশিত কুমার বিশ্বাসের বয়স ৩৩ বছর। যুদ্ধের বর্ননা দিলেন এভাবেÑ হটাৎ হেলিকপ্টারে বোমার আক্রমণ, অনেক মানুষ হতাহত হলো। মেহেরপুর হাসপাতালের পাশেই আমার লন্ডির দোকান। অনেক আহত মানুষ হাসপাতলে ভর্তি হলো। আমি ততক্ষণাৎ দোকান বন্ধ করে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। ঔষধ আনা, ডাক্তারের হুকুম মত সেবা করা, আহতদের স্বজনদের কাছে খবর পৌঁছানোর কাজগুলো করেছি। মেহেরপুরের এমএনএ ছহিউদ্দীন মিয়ার কাছে যুদ্ধে যাওয়ার আবেদন করলে উনি বলেছিলেন, তোর সংসার বড়, অনেক ছেলেমেয়ে ভাই-বোন, বাবা-মা তুই একা উপার্জন করিস তাই সংসার ফেলে যুদ্ধে গেলে ওরা খাবে কি? কিছুদিনের মধ্যেই এলাকার রাজাকাররা হিন্দুদের উপর অত্যাচার শুরু করলো উপায়ন্তর না পেয়ে পরিবারের সকলকে নিয়ে ভারতে চলে যাই।
মুক্তিনাথ বিশ্বাস বলেন, মেহেরপুরে থেকে অনেকের সাথে কুষ্টিয়ার গিয়েছি পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ করার জন্য। ভৈরব নদের পাড়ে মানুষ মেরে গর্তে পুতে রাখতে দেখেছি নিজ চোখে। গভীপুর গ্রামের সকলের পরিচিত রাজাকার ভৈরব নদের নৌকার মাঝি আওলাদ হোসেন। সে কোন মুক্তিযোদ্ধা বা হিন্দুদের নৌকায় পারাপার করত না। স্বাধীনতা বিরোধীরা এমন অত্যাচার শুরু করেছিলো উপান্তর না পেয়ে ভারতে পালিয়ে যাই। স্বাধীনতার পর বাড়িতে এসে দেখি কোন ঘর-বাড়ি বলে কিছুই নেই, সব পুড়িয়ে ফেলেছিলো। পরবতীর্তে শুনেছি মুক্তিযোদ্ধারা আওলাদ মাঝিকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল।
রঞ্জিত কুমার দাসের দেখা মুক্তিযুদ্ধ মেহেরপুরে যাতে পাকিস্তানি আর্মিরা ঢুকতে না পারে সেজন্য গকুলখালি ব্রীজ ও দিনদত্ত ব্রীজের কিছু অংশ ভেঙে দিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। তারা লোহার স্লিপার বসিয়ে গাড়ি পার করে মেহেরপুরে ঢুকে পড়ে। তারপরই আমরা পালিয়ে যাই ভারতে। ভারতের বেতায় লাল বাজার ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং এর জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু সংসারে অভাব থাকায় ট্রেনিং না নিয়ে অর্থ উপার্জন করতে বাধ্য হয়েছিলাম।
সমীর কুমার বিশ্বাস বলেন, আমাদের গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা কাইয়ুম চৌধুরীর সাথে অল্প সময় থেকেছি। মেহেরপুরের সেই সময়ের এসডিও তৌফিক এলাহি চৌধুরীর নির্দেশে গ্রমের বীর মুক্তিযোদ্ধা সফর মোল্লকে (ড্রাইভার) দেখেছি, টাকা ভর্তি ছোট গাড়ি নিয়ে ভারতে যাচ্ছিলেন। তারপর যখন পাক হানাদারদের সাথে এলাকার রাজাকাররা অত্যাচার শুরু করলো তখন পরিবার নিয়ে ভারতে পালিয়ে যাই। স্বাধীনতার পর ফিরে এসে বাড়ি-ঘর বলতে কিছুই পায়নি, ওরা সবই পুড়িয়ে দিয়ে ছিল।
মেহেরপুরের বিশিষ্ট লেখক এবং কবি বাশরী মোহন দাস বলেন, ৭১ এর যুদ্ধটি ছিলো জনযুদ্ধ। কিন্তু ইতিহাসে এখনো তা যথাযথভাবে প্রতিফলিত বা স্বীকৃত হয়নি। দলিত শ্রেণী সবসময়ই অসচ্ছল, অসচেতন, শিক্ষা দিক্ষা কম কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের মৌন সমর্থন ছিল শতভাগ।
জীবন রক্ষার তাগিদে হয়তবা তারা ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল। আমার বয়স তখন ১৬ বছর, দশম শ্রেণীর ছাত্র আমি। চোখের সামনে অনেক নির্যাতন হতে দেখেছি। যারা নির্যাতন করলো তাদের নাম গুলো আজও ভয়ে বলতে পারি না। এদেশ থেকে হিন্দু ভারতে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও দলিত জনগোষ্টীর তেমন কেউ ভারতে পাড়ি জমায়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরে কেউই তাদের বসত ভিটা ফিরে পাইনি। সকলের বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি বা এদেশের রাজাকাররা। আমাদের পরিবারও একই পরিণতির শিকার হয়েছিলো।
গাংনীর শিমুলতলা গ্রামের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক নীলমণি গোস্বামী বয়স ৭১ বছর। তিনি বলেন একাত্তরে যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১৭-১৮ বছর। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমি অস্ত্র, খাবার ঘাড়ে করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দিয়েছি। কুঞ্জনগর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মতিন এবং সহড়াবাড়িয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা পাতান মাস্টার এই দুজনের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। বাবা গ্রাম পুলিশের চাকরি করতো, ট্যাক্স আদায় করার জন্য চেয়ারম্যান সাহেব তাগাদা দিত, বাবা গ্রামের বিভিন্ন কাজে গেলে রাজাকাররা হিন্দু বলে টর্চার করতো। সংসারের অভাব ও বাবা-মায়ের কারণে যুদ্ধে যেতে পারিনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হোক এটা শতভাগ চেয়েছি।
একাত্তরের এই সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে নিবিড় ভাবে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হলেও মেহেরপুরের দলিত জনগোষ্ঠীর অনেরই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা। যা এখানে তুলে ধরা সম্ভব হলো না। যুদ্ধের সময়ে এমনও অনেক কাহিনি আছে যা শুনে বেদনায় শিহরিত হতে হয়। বাংলাদেশ হোক সকল সম্প্রদায়ের অসাম্প্রদায়িক দেশ এটিই সকলের চাওয়া।
লেখক: ব্যবস্থাপনা সম্পাদক,মেহেরপুর প্রতিদিন ও সাধারণ সম্পাদক, মেহেরপুর জেলা প্রেস ক্লাব।