পরিবার হলো সমাজ-সংগঠনের একক। অর্থাৎ এই পরিবারের সমষ্টিই সমাজ। ফলে সামাজিক শৃঙ্খলা ও শান্তির মূল উৎসভূমিই হলো পরিবার। একটি পরিবারের স্তম্ভ¢ হলো দুটি৷ নারী-পুরুষ তথা স্বামী ও স্ত্রী৷ এই পারিবারিক শৃঙ্খলা, শান্তি ও ভালবাসা টিকিয়ে রাখতে স্বামী ও স্ত্রীর রয়েছে অনেক দায়িত্ব।
আজকের প্রবন্ধে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব সম্পর্কিত ইসলামে যে নির্দেশনা রয়েছে তা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করব, ইনশাল্লাহ্।
১.শরী’আতসম্মত প্রত্যেক কাজে স্বামীর আনুগত্য করা।
২.অবাধ্য না হওয়া: শরী’আত বিরোধী আদেশ ব্যতিত স্বামীর অবাধ্য না হওয়া। স্বামীর শরী’আত বিরোধী কোনো কাজের আদেশ পালন করা স্ত্রীর জন্য জায়িজ নয়। তা অমান্য করাই ঈমানদার স্ত্রীর কর্তব্য। কাজেই গুনাহ এবং শরী’আত বিরোধী কোন কাজে স্বামী আদেশ করলে তার নিকটে এব্যাপারে অপারগতা তুলে ধরা এবং তাকে নরম ভাষায় বোঝানো।
৩. শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে উত্তম আচরন করা।
৪. আদব রক্ষা করে চলা।
৫. কৃতজ্ঞ হওয়া: জগত সংসারে এমন অনেক নারী রয়েছেন, যাদের অধিকাংশই পরশ্রীকাতর হয়ে থাকেন। প্রতিবেশীদের ঘরে এটা আছে, সেটা আছে আমাদের কেন নেই-আমাদের অবশ্যই সেটা থাকতে হবে। স্বামীর আয় রোজগারের কথা না ভেবেই এরকম চিন্তা করেন। স্বামী যদি তাঁর আর্থিক সমস্যার কথা জানান, তাহলে উল্টো বলে বসেন-অন্যদের থাকলে তোমার কেন নেই, তুমি একটা বুদ্ধু, হাবা ইত্যাদি। তখন যদি স্ত্রী বলে ফেলে আহা! আমার বিয়েটা যদি অমুকের সাথে হতো, তাহলে কতোই না ভালো হত! কিংবা কী চেয়েছিলাম, আর কী পেলাম! ইত্যাদি। এতে করে স্বামী পুরুষটি ভীষণভাবে মর্মাহত হন, হতাশায় ভোগেন। সব সময় তার মনে স্ত্রীর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের বিষয়টি কাজ করে। স্ত্রীর কাছে নিজেকে নতজানু মনে হতে হতে সকল আগ্রহ-উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলেন-যার পরিণতি খুবই অপ্রত্যাশিত।
৬. পরস্পরের প্রতি গভীর আস্থা ও বিশ্বাস রাখা: আমাদের প্রতিবেশী বা নিকটজনদের অনেকেই আছে যারা হিংসুক, পরশ্রীকাতর ও প্রতিহিংসা পরায়ণ। যদি কোন পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মধুর সম্পর্ক থাকে, তাদের তা সহ্য হয় না, এই পরশ্রীকাতর মানুষ গুলির আর ঘুম হয়না তারা উঠে পড়ে লাগে তাদের সম্পর্কের মাঝে অবনতি ঘটানোর জন্য।
যর্থাথই বলেছেন একজন দার্শনিক ‘হিংসুক এ চিন্তাতেই শুকিয়ে যায় যে তার প্রতিবেশী কেন এতো সুখে থাকে।’
মনে রাখতে হবে, এসব ক্ষেত্রে নিন্দুকেরা এমন সব গুজব ছড়ায়, যা থেকে রেহাই পেতে হলে প্রয়োজন ঠান্ডা মাথায় সংবেদনশীল মন নিয়ে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের মাঝে বিষয়টি আলোচনা করা। সত্য না জেনেই কোন রকম সিদ্ধান্ত নেয়া, বাড়াবাড়ি করা মারাত্মক ভুল।
৭. সর্বদা স্বামীর মন জয় করার চেষ্টা করা।
৮. স্বামীকে অসন্তুষ্ট না রাখা।
৯. স্বামীর সাথে অসংযত আচরণ না করা।
১০. স্বামীকে কষ্ট না দেওয়া।
১১. ধৈর্য, দৃঢ়তা ও বিচক্ষনাতার সাথে সাথে সব প্রতিকূল অবস্থার মুকাবিলা করা।
১২. দুঃখ-কষ্ট ও মুসীবতের সময় হা-হুতাশ না করা, ধৈর্যধারণ করা।
১৩. স্বামী অফিস, ব্যবসা বা বাইরে থেকে বাসায় ফেরার পর স্ত্রীদের উচিত এমন আচরণ করা, যাতে বোঝা যায় যে, তার আগমনে স্ত্রী ভীষণ খুশী ও আনন্দিত হয়েছে।
১৪. স্বামী বিদেশ কিংবা বাইরে থেকে আসলে, স্ত্রী সব কাজ ফেলে সামনে এসে প্রথমেই হাসিমুখে তার কুশল জিজ্ঞাসা করবে। টাকা-পয়সা বা আমার জন্য কি কি এনেছেন, বাক্স বা থলের মধ্যে কি আছে? এই ধরনের কথাবার্তা বলবে না। কোনরূপ নাখোশী বা বিরক্ত ভাব প্রকাশ করবে না।
১৫. স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য ঘরের ভিতরে সাজগোজ করা।
১৬. স্বামীর ভালোলাগা মন্দলাগার দিকে সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখা।
১৭. আল্লাহর দীন পালনের জন্য ইবাদত বন্দেগীর পথে একে অপরকে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করা।
১৮.প্রয়োজনাতিরিক্ত ভরণ-পোষণ দাবি না করা।
১৯. স্বামী যদি স্ত্রী অপেক্ষা অস্বচ্ছল হয় তাহলে স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীকে সাহায্য সহযোগীতা করা।
২০. আল্লাহর রাজিখুশির জন্য ঘর-গৃহস্থালীর কাজকর্ম ও সন্তান প্রতিপালনে স্বামীকে যথাসাধ্য সাহায্য করা। রসূলাল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘর-গৃহস্থালীর যাবতীয় দায়িত্ব অন্যের উপর ছেড়ে না দিয়ে হযরত খাদীজা রাযিয়াল্লাহু আনহা নিজই সম্পন্ন করতেন।
২১. স্বামীর আত্মমর্যাদাবোধের প্রতি খেয়াল রাখা।
২২.শরী’আত অনুমদন করে না এমন বিষয়ে পরপুরুষের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক না রাখা।
২৩.স্বামীর আমানত হিসেবে নিজের ইজ্জত-আব্রু হেফাযত করা। কোনো ধরনের খেয়ানত না করা।
২৪.স্বামীর অনুমতি ছাড়া কাউকে ঘরে ঢোকার অনুমিত না দেওয়া।
২৫. স্বামীর অনুমতি ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়া: স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক। যদি কোন সময় কোন কারণে অকারণে উভয়ের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ সংঘটিত হয় তাহলে স্ত্রী ধৈর্যের সাথে ঝগড়া বিবাদ এড়িয়ে চলবে এবং সুযোগ সাপেক্ষ স্বামীকে বুঝাবে। এমতাবস্থায় রাগবশত স্বামীর গৃহ ত্যাগ করবে না।
২৬.স্বামীর সম্পদ হেফাযত করা। অনুমতি ছাড়া সেখান থেকে কাউকে কোনো কিছু না দেওয়া।
২৭.স্বামীকে অসন্তুষ্ট করে অতিরিক্ত নফল ইবাদতে মশগুল না থাকা। যেমন অতিরিক্ত নফল নামাজ, রোযা না রাখা।
২৮.স্বামী মেলামেশার জন্য আহবান করলে শরী’আতসম্মত কোনো ওযর না থাকলে আপত্তি না করা।
২৯.স্বামী দরিদ্র কিংবা অসুন্দর হওয়ার কারণে তাকে তুচ্ছ না করা।
৩০.স্বামীকে কোনো গুনাহের কাজ করতে দেখলে আদবের সাথে তাকে বিরত রাখা।
৩১.স্বামীর নাম ধরে না ডাকা।
৩২.কারো কাছে স্বামীর বদনাম, দোষ-ত্রুটি বর্ণনা না করা।
৩৩.শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামীর ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনেকে সম্মানের পাত্র মনে করা। তাদেরকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করা। তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করা। ঝগড়া-বিবাদ কিংবা অন্য কোনো উপায়ে তাদের মনে কষ্ট না দেওয়া।
৩৪.স্বামীর মৃত্যুর পরও স্ত্রীর তাঁর স্বামীর প্রতি কর্তব্য রয়েছে। ইয়াতীম সন্তানদের লালন পালন ও তাদের মানুষ করা। স্বামীর ধন-সম্পদ রক্ষা করা। স্বামীর সুনাম রক্ষা করা, স্বামীর আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবদের সাথে সুন্দর ব্যবহার করা। স্বামীর অসম্পূর্ণ কাজ সমাধান করা। যদি স্বামীর কোন ঋণ থাকে, তা পরিশোধ করে দেওয়া এবং সর্বদা স্বামীর মাগফিরাতের জন্য আল্লাহ্র নিকট দু’আ করা।
মহান আল্লাহ তা’য়ালা স্বামীর যথার্থ কল্যাণ কামনার মাধ্যমে আমাদের তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করার তৌফিক দান করুন, অমিন।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
লেখক:
বায়োকেমিস্ট, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রনালয়, খুলনা।