এইতো এক যুগেরও আগের কথা, উন্নয়নের তলানিতে ডুবে ছিলো এই দেশ। লুটতরাজ ও দুর্নীতিবাজরা দেশে দুঃশাসন প্রতিষ্ঠা করে দেশকে পিছিয়ে নিতে তৎপর ছিলো। চেয়েছিলো অবৈধ পথে ক্ষমতায় বসতে কিন্তু ২০০৯ সালে জনগনের ভোটের রায়ে অশুভ শক্তির সকল অপচেষ্টা বিফলে যায়। সফল রাষ্ট্রনায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২য় মেয়াদে এই দেশের মানুষ অভিভাবকের আসনে বসান। সেই থেকে রচিত হতে থাকে উন্নয়নের মহাকাব্য।
সুপরিকল্পিতভাবে দেশের সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করতে থাকেন তিনি। গ্রাম থেকে শহর বাংলাদেশের সকল স্থানে উন্নয়নের ছোয়া লাগা শুরু হয়। দেশের মানুষকে এখন আর আদিম যুগের মতো পরনির্ভরশীল থাকতে হয় না। ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদেরকে আত্মনির্ভরশীল হতে সহায়তা করেছে, প্রযুক্তি হয়েছে সহজলভ্য।
সকল উন্নয়ন ও প্রযুক্তির বিস্তারের পর তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের। ইতিমধ্যে এর সফল বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। সরকারের সদিচ্ছার ন্যায় দেশের সকল শ্রেণী পেশার মানুষদেরও এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ আমাদের সবার। দেশ স্মার্ট হলে এ জাতি স্মার্ট হবে। তাই সরকারকে সর্বোচ্চ সহযোগীতা করতে হবে সকলের।
স্মার্ট বাংলাদেশ হবে আমাদের সকলের একটি প্রতিশ্রুতি ও শ্লোগান যা ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের পরিকল্পনা। স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার চারটি ভিত্তি রয়েছে। স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট সমাজ। স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে এ চারটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করে অগ্রসর হলে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের কোনো অবশিষ্ট থাকবে না। স্মার্ট নাগরিক ও স্মার্ট সরকার এর মাধ্যমে সব সেবা এবং মাধ্যম ডিজিটালে রূপান্তরিত হবে। আর স্মার্ট সমাজ ও স্মার্ট অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করলে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
‘স্মার্ট বাংলাদেশ হবে সাশ্রয়ী, টেকসই, জ্ঞানভিত্তিক, বুদ্ধিদীপ্ত ও উদ্ভাবনী। এককথায় সব কাজই হবে স্মার্ট। যেমন স্মার্ট শহর ও স্মার্ট গ্রাম বাস্তবায়নের জন্য স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা, স্মার্ট পরিবহন, স্মার্ট ইউটিলিটিজ, নগর প্রশাসন, জননিরাপত্তা, কৃষি, ইন্টারনেট সংযোগ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। অনলাইনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে এক শিক্ষার্থী, এক ল্যাপটপ, এক স্বপ্নের উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এর আওতায় সব ডিজিটাল সেবা কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত ক্লাউডের আওতায় নিয়ে আসা হবে। ইতোমধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের নাম পরিবর্তন করে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’ গঠন করেছে বাংলাদেশ সরকার। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’ এর নয়টি কার্যপরিধিও সুস্পষ্ট করেছে সরকার যথা- ১. অগ্রসরমান তথ্যপ্রযুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে দিক নির্দেশনা প্রদান; ২। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও আর্থিক খাতের কার্যক্রম স্মার্ট পদ্ধতিতে রূপান্তরের সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দিক নির্দেশনা প্রদান; ৩. স্মার্ট ও সর্বত্র বিরাজমান সরকার গড়ে তোলার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক, বাণিজ্যিক ও বৈজ্ঞানিক পরিমন্ডলে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিধি-বিধান প্রণয়নে দিক নির্দেশনা প্রদান; ৪. বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান; ৫. এজেন্সি ফর নলেজ অন এরানোটিক্যাল অ্যান্ড স্পেস হরাইজন (আকাশ) প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান; ৬. ব্লেন্ডেড এডুকেশন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং ফাইভজি সেবা চালু পরবর্তী সময়ে ব্যান্ডউইথের চাহিদা বিবেচনায় চতুর্থ সাবমেরিন ক্যাবলে সংযোগের প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান; ৭. রপ্তানি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মেড ইন বাংলাদেশ পলিসি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সময়াবদ্ধ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে দিক নির্দেশনা প্রদান; ৮. আর্থিক খাতের ডিজিটালাইজেশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান এবং ৯. স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১ (স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমি এবং স্মার্ট গর্ভমেন্ট) বাস্তবায়নে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়নে দিক নির্দেশনা প্রদান।
স্মার্ট বাংলাদেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও আর্থিক খাতের কার্যক্রম স্মার্ট পদ্ধতিতে রূপান্তর করবে আওয়ামী লীগ সরকার। স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন এবং এর উন্নয়নে একটি দক্ষ ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। সরকারি বিভিন্ন সেবা কার্যক্রম ডিজিটাইজেশন করা হবে। সুতারং সরকার আগামী ২০৪১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে আদর্শগত এমন রূপান্তর ঘটাবে যেখানে সকল সেবার ভিড়ে না হারিয়ে নাগরিকগণ নিজের প্রয়োজনীয় সেবা সহজে খুঁজে পাবেন; সেবা গ্রহিতার দায় নয় সেবা প্রদানকারীর দায়কে শক্তভাবে দেখা হবে; সরবরাহ কেন্দ্রিক থেকে চাহিদা কেন্দ্রিক সার্ভিসের যোগান হবে; নাগরিকগণকে এখন ডিজিটাল মাধ্যমেও নানান চ্যানেলে (অ্যাপ, ওয়েব, কল সেন্টার ইত্যাদি নানা প্লাটফর্ম ব্যবহার করতে হয়) সেবা গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু স্মার্ট বাংলাদেশে একটি মাত্র প্লাটফর্ম থেকে নাগরিকগণ সকল চাহিত সেবা পাবেন। নানান পরিচয় নম্বরের (যেমন এনআইডি, পাসপোর্ট, জন্ম নিবন্ধন নম্বর ইত্যাদি) পরিবর্তে একটি পরিচয় নম্বর (ইউনিক আইডি) দিয়ে সকল কার্যক্রম সম্পাদন এবং সরকারি সেবা প্রদানকে দেখা হবে সেবা গ্রহিতার চোখে, সেবা দাতার চোখে নয়।
এক সময় টাকা নগদ তুলে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে জমা করতে হতো। কারণ, এক ব্যাংকের চেক অন্য ব্যাংক গ্রহণ করত না। পরে চেক গ্রহণ করলেও সেই টাকা জমা হতে বেশ কয়েক দিন সময় লেগে যেত। আবার এক ব্যাংক থেকে বস্তা ভর্তি টাকা তুলে অন্য ব্যাংকে জমা করতেও দেখা যেত। অন্য কারও হিসাবে বা কাউকে টাকা পাঠাতে ব্যাংকে লাইন পড়ে যেত। আবার টাকা পাঠানোর জন্য কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসাও ছিল জমজমাট। কেনাকাটা ও লেনদেনের পুরোটাই হতো নগদ টাকায়। পরিসেবা বিল পরিশোধের জন্য ব্যাংকগুলোতে লাইন লেগে থাকত। মোবাইলে টাকা রিচার্জ করতেও প্রতিটি বাজার ও মহল্লায় ছিল একাধিক দোকান। নতুন প্রজন্মের কাছে এসব সাজানো গল্প মনে হতে পারে। তবে বাস্তবতা হলো আর্থিক লেনদেনে প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে এসব এখন অনেক কিছুই ইতিহাসের অংশ।
ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডে কেনাকাটা, মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস), ইন্টারনেট ব্যাংকিং, অ্যাপসে লেনদেন, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার, রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্টসহ এমন নানামুখী ডিজিটাল লেনদেন জীবনে এনে দিয়েছে স্বাচ্ছন্দ্য। নগদ টাকা বহনের ঝামেলা কমিয়ে দিয়েছে। জীবনকে সহজ করে দিয়েছে। আর প্রতিটি লেনদেনে থাকছে ডিজিটাল রেকর্ড। যা প্রয়োজনমতো ব্যবহার করা যাচ্ছে। এখন কার্ডের পরিবর্তে অ্যাপস,কিউআর কোড ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। মুঠোফোনই হয়ে উঠছে লেনদেনের বড় মাধ্যম। ব্যাংকগুলোর ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড এবং বিকাশ, রকেট, নগদ, উপায়,মাই ক্যাশ,ট্যাপের মতো এমএফএসের কারণে সাধারণ মানুষ ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
স্মার্ট ইকোনমির অংশ হিসেবে বাংলাদেশী নাগরিকদের প্রবাস যাত্রা সহজ করতে এবং প্রবাসে যাওয়ার প্রস্তুতিমূলক কাগজপত্র ও সেবাসমূহ একটি ওয়ান স্টপ সার্ভিস পয়েন্ট থেকে প্রদানের লক্ষ্যে দেশব্যাপী ডিজিটাল সেন্টারগুলোতে প্রবাসী হেল্প ডেস্ক চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারের আর্থিক অন্তর্ভূক্তি কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা ও আর্থিক অন্তর্ভূক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে এটুআই চালু করেছে ‘সাথী’ নামক একটি নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশ ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের সহযোগিতায় এটুআই প্রাথমিক পর্যায়ে ডিজিটাল সেন্টারের নারী উদ্যোক্তা নিয়ে এই নেটওয়ার্কের যাত্রা শুরু করেছে। দেশের সকল পরিষেবা বিল, শিক্ষা সংক্রান্ত ফি ও অন্যান্য সকল ধরনের সরকারি সেবার বিল প্রদানের পদ্ধতি সহজ ও সমন্বিতকরণে চালু হওয়া সমন্বিত পেমেন্ট প্ল্যাটফরম ‘একপে’-তে বিভিন্ন ধরনের করতে নতুন ৮টি আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের নতুন পেমেন্ট চ্যানেল যুক্তকরণ।
সর্বোপরি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এবং আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় এই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে।
লেখক:কোষাধ্যক্ষ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়