ফের হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়ায়ের কারণে দেশে অর্থনীতিতে সংকট আরও বাড়াবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গবেষক–অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, দুই বছরের করোনা মহামারীর ধাক্কা কাটতে না কাটতেই পৌনে দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এমনিতেই সংকটে আছে দেশের অর্থনীতি। ফের রাজনীতির মাঠ সহিংস হয়ে উঠলে দেশে অর্থনীতিতে সংকট প্রকট আকার ধারণ করবে।
দেশের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, “বেশ ভালোই চলছিল। বেশ কিছুদিন হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও ছিল না। আবার শুরু হয়েছে অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এ সব ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি। আর এতে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন।’
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ভরশীল। বর্তমানে অর্থনীতি কঠিন সময় পার করছে। ডলার সংকটের কারণে এলসি করা যাচ্ছে না। কাঁচামালের অভাবে অনেক কারখানা পুরোপুরি উৎপাদন করতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে সংঘাতের রাজনীতি অর্থনীতিতে সংকট আরও ঘনীভূত হবে।” রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে কর্মসূচি নেওয়ার আহ্বান জানান এই ব্যবসায়ী নেতা।
মেট্রোপলিটান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির(এমসিসিআই) সভাপতি সায়ফুল ইসলাম বলেন, ‘যার যার জায়গা থেকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করার ফলে করোনা মহামারীকে বাংলাদেশ ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পেরেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতিসহ নানান চ্যালেঞ্জ এসেছে অর্থনীতিতে। এরকম পরিস্থিতির মধ্যে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচির ফলে অস্থিরতা দেখা দিলে অর্থনীতিতে তা আরও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।’
তিনি বলেন, “গত কয়েক বছরে দেশের অবকাঠামোখাতে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এখন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ নিয়ে নতুন করে ভাবছেন। সবাই ভাবছেন, বাংলাদেশ আগামীতে ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হবে। স্থানীয় উদ্যোক্তারা অপেক্ষা করছেন একটি সুন্দর নির্বাচনের জন্য। এরকম সময়ে কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা কাম্য নয়।”
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “বৈশ্বিক পরিস্থিতি ভালো নয়। ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা কমছে। এরমধ্যে দেশের ভেতরে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে রপ্তানিমুখী শিল্প খুবই সংকটে পড়বে। এরকম সময়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি। অস্থিরতা হলে ক্রেতারা বিকল্প খুঁজবেন। অর্থনীতিতে চাপ আরও বাড়বে।”
তিনি বলেন, “অর্থনীতি এমনিতেই খারাপের দিকে রয়েছে। রিজার্ভের পতন ঠেকছে না। আছে ডলার–সংকট। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও শেষ হচ্ছে না। ওই যুদ্ধের খারাপ ফল আমরা এখনো ভোগ করছি। নতুন করে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা, যা আমাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।” তবে রাজনৈতিক পক্ষগুলো শান্তিপূর্ণ সমাধানের ব্যাপারে উদ্যোগ নেবে বলেও আশাবাদী ফারুক হাসান।
বস্ত্রশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, “দেশের বস্ত্র খাতসহ অন্যান্য শিল্প গভীর সংকটে আছে। প্রয়োজনীয় ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। এরকম সময়ে কোনো ধরনের অচলাবস্থা দেখা দিলে প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরি মারা যাবে।”
“ব্যবসায়ীরা অবশ্যই শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু নির্বাচন চান। রাজনৈতিক দলগুলো কর্মসূচি নেবে, সেটাতে ব্যবসায়ীদের সমর্থন রয়েছে। তবে কোনো ধরনের অস্থিরতা, সহিংসতা হলে সেটা সামগ্রিক ব্যবসা বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে,” যোগ করেন তিনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এটা বাংলাদেশের ব্যর্থতা; বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের। নির্বাচন এলেই এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, যার খেসারত দিতে হয় পুরো দেশকে। এবারও সংঘাত দেখা দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে– এই সংঘাত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।”
“সংঘাত চরম আকার নিলে তার অর্থনৈতিক প্রভাব হবে ব্যাপক। কারণ এবার অন্যান্য সময়ের তুলনায় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ দুর্বল, বৈশ্বিক অবস্থাও পক্ষে নেই,” বলেন তিনি।
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, “যেকোনোভাবে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমেই হতে হবে। নতুবা রাজনৈতিক দল, দেশ সবাই হারবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে অর্থনীতি আর সাধারণ মানুষ।”
তিনি আরও বলেন, “অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। রাজনীতি ঠিক না থাকলে কিছুই ঠিক থাকবে না। নিরাপত্তা এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে যাচ্ছে। যখন নিরাপত্তা থাকবে না, তখন বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবেন না।”