বাংলাদেশের অর্জনের মুকুটের সবচেয়ে মূল্যবান রত্নটি হচ্ছে কৃষিখাতের অবিস্মরণীয় অগ্রগতি। সারা বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বনির্ভর একটি দেশ। খাদ্যে স্বনির্ভরতার পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষকে পুষ্টি নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত‘ করার ঘোষণা দিয়েছলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে শেখ হাসিনার সরকার বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছন। ক্রমবর্ধমান মানুষের অতিরিক্ত চাহিদা মেটানোর জন্য দেশে মাংস উৎপাদন বাড়ানোর জন্য গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের আওতায় প্রানীসম্পদ অধিদপ্তর কৃষকদের উৎসাহিত করছে, প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে গরু জবাই করার জন্য প্রাণিসম্পদ ও দুগ্ধ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় সরকার দেশের বিভিন্ন জেলায় আধুনিক কসাইখানা স্থাপন করছে।
কৃষকের খামারে বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদিত দুধ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও প্যাকেজিং করে বাজারজাত করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে কৃষকদের উৎসাহিত করার ব্যবস্থা রেখেছে সরকার। কিন্তু তারপরও প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকার নানান কারণের মধ্যে একটি বড় কারণ হল রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সিন্ডিকেট।
দেশ যখন অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তখন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এবং সরকার বিরোধী মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দেশকে অস্তিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে একের পর এক হরতাল অবরোধ দিয়ে দেশের অগ্রসরমান অর্থনীতিকে ধসিয়ে দেয়ার হীন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবীর সময় সংবাদকে দেয়া এক বক্তব্যে বলেছেন, “২০১৩ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল ১১ লাখ কোটি টাকা। যা ২০২৩ সালে বেড়ে হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ কোটি টাকা।
অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হরতালে দৈনিক ক্ষতির পরিমাণও বেড়েছে। বর্তমানে দেশে একদিনের হরতালে ক্ষতির পরিমাণ ৬ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা”। সরকার বিরোধীদের হরতাল-অবরোধে ‘সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দিনমজুর ও এসএমই খাত।
সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, যা আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক উভয়কেই ইতোমধ্যে সংকটজনক অর্থনৈতিক সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শিশু ও যুবকদের শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।’
অর্থনীতিবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, সরকারবিরোধীদের বিক্ষোভ দেশের অর্থনীতিতেও আঘাত হেনেছে। কোভিড-১৯ বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানো অর্থনীতি এখন বৈদেশিক মুদ্র্রার ঘাটতি, টাকার মান ৩০ শতাংশের বেশি কমে যাওয়া, দুই অংকের মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি ও শ্রমের উচ্চ মূল্যের সঙ্গে লড়াই করছে।
‘বৈশ্বিক অস্থিরতার যে প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়েছে সেখান থেকে এখনও বাংলাদেশ বের হয়ে আসতে পারেনি। অন্যদিকে বাজারে মূল্যস্ফীতিও রয়েছে উচ্চমাত্রায়। এই অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে হরতাল দেশের অর্থনীতিতে ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
রাজনীতি বিষয়ে বাংলাদেশি ইংরেজি ভাষার bdanalytica -এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে জানা যায়, চলমান হরতালে ‘বাস এবং ট্রাকগুলোকে লক্ষ্য করে অন্তত ১১০টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। ফলে যোগাযোগ খাতে (ট্রান্সপোর্টেশনে) তৈরি হয়েছে কৃত্রিম অচলাবস্থা।
এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মানুষ স্থানান্তরিত হতে পারছে না। মুখ থুবড়ে পড়ছে ব্যবসাসহ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানা কার্যক্রম। অর্থনৈগতিক গতিশীলতা ধরে রাখতে হরতাল উপেক্ষা করে কিছু মানুষ বের হলেও দুর্বৃত্তরা যখন বাসে আগুন দেয়া শুরু করলো, তখন জানমালের নিরাপত্তার জন্য মানুষ খুব বেশি প্রয়োজন না হলে ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না, ব্যবসার জন্য মালামাল এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে আসতে পারছে না। আতংকিত হয়ে পড়েছে মানুষ।
একান্ত জরুরী প্রয়োজন ছাড়া কেউই তেমন হরতালের দিনগুলোতে ঘরের বাইরে যাচ্ছে না। জীবন-জীবিকার তাগিদে হরতাল উপেক্ষা করে হাট-বাজার খোলা থাকলেও বাজারগুলোতে নেই আগের মতো মানুষের ভিড়।
হরতালে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা। ফলে গো-খাদ্য সহ সকল জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে।খামারিরাও খাদ্য ক্রয় করতে গিয়ে পড়ছেন বিপাকে। আবার পালিত গরু-ছাগল হাট-বাজারে নিয়ে গেলেও মিলছে না ক্রেতা। ফলে উভয় সংকটের মধ্য দিয়ে দিনানিপাত করছেন প্রান্তিক খামারিরা। অথচ কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় এবং দেশের আপামর জনগোষ্ঠির পুষ্টি নিরাপত্তায় প্রাণিসম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপিতে স্থিরমূল্যে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১.৯০%, প্রবৃদ্ধির হার ৩.০৪% এবং মোট কৃষিজ জিডিপি’তে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১৬.৫২%। তাছাড়া ২০২১-২২ অর্থ বছরে প্রাণিসম্পদ খাতে জিডিপির আকার ছিল ৬৭,১৮৯.০০ কোটি টাকা যা বিগত ২০২০-২১ অর্থ বছরের তুলনায় ১৬,৮৮৮.০০ কোটি টাকা বেশি (বিবিএস, ২০২২)।
২০২৩ সালে এসে বিরোধীদলের একের পর এক হরতাল অবরোধে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত জিডিপিতে অবদান রাখা এই খাতটি। প্রাণিসম্পদ খাতের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত রাখতে হলে রাজনৈতিক সহিংসতা পরিহার করতে হবে। মানুষসহ সকল প্রাণীর খাদ্য/পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি) দিনাজপুর-৫২০০।