বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী তৎকালীন ডাইরেক্টর জেনারেল অফ ইন্টেলিজেন্স এর ডিজিএফআই ঢাকার ডিটাসমেনট এর প্রধান এবং বৃহত্তর সুন্দরবন এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খ্যাত মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ আদালতে দেয়া সাক্ষ্যে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালের সন্ধ্যায় তিনি বঙ্গভবনে যান সেখানে রাষ্ট্রপতি রুমে বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক তাহেরউদ্দিন ঠাকুর মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল এমএইচ খান বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার সামরিক সচিব কর্নেল জামিল ঘাতকদের সদস্যমেজর ডালিম মেজর শাহরিয়ার রশিদ মেজর ফারুক মেজর নূর মেজর মহিউদ্দিন মেজর আজিজ পাশা আলোচনারত ছিলেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা খুনি মোশতাক তাহের ঠাকুর মাহবুব আলমসহ অনেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেদিন বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জড়িত ছিল। দেশবাসী যা চাই সব ক্ষেত্রে তার প্রাপ্তি ঘটে না নইলে আব্রাহাম লিংকন ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিবেন কেন? তার এমন মৃত্যু কি কেউ কামনা করেছিল? কেউ কি কামনা করেছিল গান্ধীজীর উন্মুক্ত বক্ষে বুলেটের আঘাত হবে ? মার্টিন লুথার কিং প্রাণহীন দেহ এমনি করে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে ঘাতকের অস্ত্রাঘাতে । চে গুয়েভারকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা। নেলসন ম্যান্ডেলাকে ফাঁসির মঞ্চথেকে ২৭ বছর কারাবরণ ।
ইন্দ্রাগান্ধীর বিশ্বস্ত বডিগার্ডদ্বারা গুলিবিদ্ধ হত্যা । রাজীব গান্ধী ফুলের বোমায় মৃত্যু বরণ। এমন গর্বিত অনেক ব্যক্তিরা অনাকাঙ্খিত হত্যা হয়েছে বিশ্ব ইতিহাসে। তার মধ্যে সবচেয়ে হৃদয় বিদারক হত্যাকাণ্ড ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এবং পরিবারের মোট ১৮ জনকে হত্যা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই এদেশের সংগ্রাম শুরু এবং তার হাত ধরেই সংগ্রামের শেষ ঠিকানা স্বপ্নের বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সাল ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা ঘোষণা এবং ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান করে প্রথম সরকার গঠন করা হয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে জাতীয় চার নেতার সাহসী নেতৃত্বে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে ৩০ লক্ষ শহীদ ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে সেদিন আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছিলাম। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ২৩ বছরের আন্দোলনে একটি স্বাধীন দেশ দিয়েছিলেন। তারপর বাঙালির অধীর অপেক্ষা যা মৃত্যুর চেয়েও কঠিন ছিল। কখন দেশে আসবে বাংলার রাখাল রাজা বঙ্গবন্ধু। তামাম বিশ্বের নেতারা এবং বিশ্ববাসী পৃথিবীর জন্য নতুন এক যোদ্ধা পেল । বিশ্ব রাজনীতিতে একদিকে প্রকৃত বন্ধু অন্যদিকে শত্রু হয়েছিল।
সব বাধা পেরিয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের জিন্দানখানা মিনওয়ালী কারাগার থেকে লন্ডন এরপর দিল্লি তারপর কাঙ্খিত স্বপ্নের সেই স্বাধীন সোনার বাংলায় বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে ফিরে আসলেন । লক্ষ লক্ষ জনতা উপস্থিত ছিল বিমান বন্দরে তাদের প্রাণ প্রিয় নেতাকে দেখতে। সেদিন বিমান বন্দরে নেমে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ঠাকুর (রবি ঠাকুর) আমার জনগণ তোমার কথাকে ভুল প্রমাণিত করেছে। সাতকোটি বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সেই মুহূর্তের আবেগ বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। কান্না জড়িত আবেগাপ্লুত কন্ঠে বলেছিলেন আমার জনগণ ছাড়া আমি বাঁচবো না।
৫২ বছর বয়সে রাষ্ট্রের ভার গ্রহণ করেন এরপর শুরু হলো দেশ গড়ার স্বপ্ন এবং সংগ্রাম অন্যদিকে ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হচ্ছিল। যুদ্ধে ধ্বংস হয়েগিয়েছিল পুরো দেশ। সে সময় ২৯২টি রেলসেতু ছিল না। হাজার হাজার সড়ক সেতু যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। গ্রামের সাথে ইউনিয়ন ইউনিয়নের সাথে থানা, থানার সাথে মহকুমা, মহকুমার সাথে জেলা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ব্যাংকে টাকা ছিলনা বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ছিল না গুদামে খাবার ছিল না । কর্ম ছিলনা নাজুক চিকিৎসা ব্যবস্থা এমনি একটা পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের দায়িত্ব নিলেন।
সারা বিশ্বের কাছে স্বীকৃতি চাইলেন দেশ গঠনে সহযোগিতার জন্য বিশ্ববাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানালেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দেশ গড়ার লক্ষ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ,সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা জাতীয় চার মূলনীতি সংবিধানে সন্নিবেশিত করে ১৯৭২ সালের সংবিধান দিলেন যা ছিল একটি রেকর্ড এবং অবিশ্বাস্য । এত স্বল্প সময়ে পরিপূর্ণ একটি সংবিধান তৈরি করা সত্যিই দুঃসাধ্য ছিল তবুও তিনি সেটি করে দেখিয়েছেন এই সেই বঙ্গবন্ধু। সদ্যস্বাধীন দেশের সাধারণ মানুষের ম্যান্ডেট গ্রহণের জন্য ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচন দিয়েস্বাধীন বাংলাদেশের নবযাত্রা শুরু করলেন ।
কখনও রাষ্ট্রপতি কখনও প্রধানমন্ত্রী কখনও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু একটি সোনার বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন একাধিক বার রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তন করে স্থায়ী পূর্ণ সমাধানে আসতে চেয়েছিলেন। কোনদিন তিনি সরকারি বাসভবনে ছিলেননা । বাঙালির অকৃত্রিম ভালবাসা আর বিশ্বাস নিয়েস্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার বাঙালির ঠিকানা ধানমন্ডির ৩২ নং এর নিজ বাড়িতেই থাকতেন। এই মানুষটার ছিল আল্লাহর উপর অগাধ বিশ্বাস এবং ভরসা। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে তিনি ঐতিহাসিক ৭মার্চ ভাষণে বলেছিলেন“রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ”।
সেদিন যখন বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়ীতে উঠছিলেন তখন তাঁর জীবনের সাথী প্রিয় ড্রাইভারটি বলেছিল আপনি জনসভায় যাচ্ছেন হাতে কাগজ পত্র কই? তখন বঙ্গবন্ধু উপরের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন কি বলবো আল্লাহ জানে। আল্লাহ আমাকে দিয়ে যা বলাবে আমি তাই বলবো। একথায় বোঝা যায় আল্লাহর প্রতি কি অগাধ বিশ্বাস ও ভরসা। বঙ্গবন্ধু জীবনে সব সেক্টরেই পদচারণা করেছেন। অনেক নেতাকে বলেছেন তোমরা শিশু হয়ে যাও। এত বিশাল হৃদয়ের মানুষটি ছিলেন শিশুর মত। তিনি শিশুর মত করেই হাসতেন।