সুবর্ণ জয়ন্তী পালন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বেশ সতর্ক এবং কৌশলী রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। দলটি হেফাজতের ডাকা হরতালে সমর্থন দেয়নি। কিন্তু ‘স্বাধীনতা দিবসে মানুষ হত্যার’ প্রতিবাদে আগামীকাল ২৯ মার্চ ঢাকাসহ সারা দেশের মহানগরীগুলোতে সমাবেশ, বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। পরের দিন ৩০ মার্চ বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়েছে জেলায় জেলায়। অথচ যে সফরকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছে, সেই ভারত বা প্রধানমন্ত্রীর মোদির বিরুদ্ধে দলটি ‘কৌশলী’ অবস্থান নিয়ে কোনো কথা বলছে না। গত কয়েক দিনে দলটি কথা বলছে কেবল সরকারের বিরুদ্ধে।
অবশ্য বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতে, ‘এখানে কৌশলের কিছু নেই।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি গণমানুষের রাজনীতি করে। সুতরাং সেই মানুষকে যখন হত্যা করা হয়, তখন আমরা চোখ বুজে থাকতে পারি না। সে জন্যই আমরা প্রতিবাদ করছি, কর্মসূচি দিয়েছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিএনপি ভারতবিরোধী কোনো দল নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও আমরা নই। কিন্তু তাঁকে নিয়ে এসে সরকার যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, এটি কারো কাম্য হতে পারে না।’
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানাচ্ছে, কর্মসূচি ঘোষণার আগে গতকাল শনিবার বিকেলে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে এমন কৌশলী অবস্থান নেওয়া হয়েছে। বৈঠকে আলোচনা হয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে মানুষের সেন্টিমেন্টের বাইরে বিএনপির যাওয়া ঠিক হবে না। তাদের মনোভাবের সঙ্গেই থাকতে হবে। ফলে দুই দিনের কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়ে গতকালই তা ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে ভারত বা সফররত প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অবস্থান স্পষ্ট না করার পক্ষেও মত দেন বিএনপির বেশির ভাগ নেতা। তাঁরা বলেন, হেফাজতের পক্ষ হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ঠিক এই মুহূর্তে যুক্তিযুক্ত হবে না। তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর নিয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে নিজেরা আগ্রহী হয়ে মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে ভালোই হয়েছে বলে বিএনপির বেশির ভাগ নেতা একমত হয়েছেন বলে জানা যায়।
ভিন্ন অপর একটি সূত্রে খবর নিয়ে জানা যায়, আজকের ডাকা হরতালের পক্ষে সমর্থন চেয়ে হেফাজতের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও বিএনপি তাতে সাড়া দেয়নি। তবে দলের কৌশলগত রাজনীতির বিষয়টি তাদের বুঝিয়ে বলা হয়েছে।
যদিও হেফাজতের হরতাল করার অধিকার আছে বলে দলগতভাবে মনে করে বিএনপি। কর্মসূচি ঘোষণার পর গতকাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, ‘প্রত্যেক নাগরিকের ন্যায়সংগত সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে প্রতিবাদ করার। সেখানে তারা যদি কোনো কর্মসূচি দেয় বা হরতাল আহ্বান করে, সেটা যৌক্তিক তো বটেই।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির সিনিয়র একাধিক নেতা কালের কণ্ঠকে জানান, হেফাজতের ডাকা হরতালের সমর্থন না দেওয়ার বিষয়টি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে নেওয়া হয়েছে। কারণ ওই কর্মসূচিতে সমর্থন করা হলে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা জড়িত হয়ে বিএনপিকে আবারও বিপাকে ফেলার চেষ্টা করতে পারে—এমন শঙ্কা তাঁদের আছে। ২০১৫ সালের বিএনপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দলটির বিরুদ্ধে ‘অগ্নিসন্ত্রাসের’ অভিযোগ উঠেছিল, যার অনেকগুলোর সঙ্গে বিএনপি জড়িত নয় বলে পরবর্তীকালে জানা গেছে।
পাশাপাশি দলের ডানপন্থী অবস্থানও এই মুহূর্তে স্পষ্ট করতে রাজি নয় বিএনপি। দলটি এখন বেশি যোগাযোগ রাখছে ডাকসুর ভিপি নুরুল হকসহ ছাত্র অধিকার পরিষদের সঙ্গে। পাশাপাশি বামদের সঙ্গেও তারা সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। ভোটের রাজনীতিতে হেফাজতকে বড় ফ্যাক্টর মনে করা হলেও দলটিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন হারানোর ভয় রয়েছে বিএনপির মধ্যে।
তবে উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং জনমনে সৃষ্ট সেন্টিমেন্টের প্রতি সামঞ্জস্য রেখে সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরিস্থিতির অবনতি হলে তারা কর্মসূচি আরো বাড়াবে। আজ রবিবার হরতালের মধ্যেও সারা দেশে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের বিক্ষোভ কর্মসূচি রয়েছে।
গত শুক্রবার বিএনপির পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতেও বায়তুল মোকাররম মসজিদে মুসল্লিদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনার নিন্দা জানিয়ে সরকারের কঠোর সমালোচনা করে বিএনপি। কিন্তু ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও সফররত প্রধানমন্ত্রী মোদি বা ভারতের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেনি দলটি।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের কর্মী মারা যাওয়ায় তারা হরতাল ডেকেছে এবং এই হরতাল ডাকার অধিকার তাদের আছে। আমরা বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে লোক এসে তো এ দেশে মানুষ মারেনি। ভারত থেকে আসা মেহমানের আগমনকে কেন্দ্র করে সরকার এই মানুষ মেরেছে। তাই প্রতিবাদও সরকারের বিরুদ্ধে।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করতে গিয়ে সরকার আজ মানুষের রক্ত ঝরিয়েছে। সংগত কারণেই বিএনপির কর্মসূচি দিতে হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিবাদের ভাষা সব দলের সব সময় এক না-ও হতে পারে। নিজেদের কর্মী মারা যাওয়ার কারণে হেফাজত হরতাল দিয়েছে। আমরাও বিক্ষোভ করে প্রতিবাদ জানাব।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভারত বা সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলাটা বিএনপি রাজনৈতিক শিষ্টাচার বলে মনে করে না। কিন্তু এক দলকে ক্রেডিট দেওয়ার জন্য সমগ্র বিষয়টা সরকার যেভাবে হ্যান্ডল করছে, সে কারণেই পরিস্থিতি আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছে।’