বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতা বিরোধী এবং পাকিস্তান সরকারের প্রতি অনুগতদের মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়া হয়। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তাকে হত্যা করা হয়। এক বছরের কম সময়ের মধ্যে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। অন্য সামরিক শাসনের মত এরশাদও বৈধতার সঙ্কট অতিক্রমের জন্য বেসমারিকিকরণের বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং জাতীয় পার্টির সৃষ্টি
সামরিক শাসক হিসাবে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে নানাবিধ আন্দোলন সংগ্রামের সম্মুখীন হন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। গ্রহণযোগ্যতা তৈরি ও গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য সময়ক্ষেপণের লক্ষ্যে প্রথমে তিনি বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন করেন। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে ইউনিয়ন পরিষদ এবং ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পৌরসভা ও মিউনিসিপ্যাল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
রাজনীতিতে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে, পূর্বসুরি সামরিক শাসকের অনুকরণে ভিতরে ভিতরে নিজস্ব রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য কলকাঠি নাড়তে থাকেন। রাজনৈতিক দল গঠন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য ১৯৮৪ সালের এপ্রিলে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিচালনার অনুমতি দেন এরশাদ। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি নামে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু সাধারণ জনগণ, সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিজ অবস্থানের ম্যান্ডেট নেবার জন্য ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ গণভোটের আয়োজন করেন। এই গণভোটে সব ধরনের কারচুপি করে ৯৪.১৪ ভাগ আস্থা ভোট লাভ করেন এরশাদ।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের মুখে তিন দফা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তন হয়। নির্বাচনের তারিখ প্রথমে ঘোষিত হয় ১৯৮৪ সালের ২৬ এপ্রিল। অবশেষে ১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৮ দলীয় জোট, জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগসহ ছোট-বড় ২৮টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে ৩০০ আসনের জন্য ২১৫৪ জন প্রার্থী মনোনয়ন দাখিল করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৫২৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে। এর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী ৪৫৩ জন। নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ৪ কোটি ৭৮ লক্ষ ৭৬ হাজার ৯৭৯ জন। এ নির্বাচনের উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোটের নির্বাচন বর্জন।
সংবিধান পরিবর্তন
আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোন শক্ত প্রতিরোধ সংসদে না থাকায় এরশাদকে একপ্রকার সাহসী করে তোলে। নিজস্ব এজেন্ডা, জনগণকে প্ররোচিত করার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসাবে ধর্মীয় আড়ালে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করে। যা তিনি পূর্বসুরি জিয়াউর রহমানের ক্ষমতাকালীন সময়ে দেখেছেন এবং শিখেছেন। জিয়া হত্যার সাজানো অভিযোগে সামরিক বাহিনীর শেষ মুক্তিযোদ্ধাপন্থী গ্রুপের ১৩ জনকে হত্যা করে নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যান এরশাদ।
প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনা করার সময় রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় আবেগকে আরো বেগবান করার লক্ষ্যে ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী আনেন। যেখানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ অটুট রাখেন এবং ‘রাষ্ট্রধর্ম’ নামে নতুন একটি অনুচ্ছেদ-২ক যুক্ত করেন।
ওই বছরই এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র ১৫ জন বিশিষ্ট নাগরিকের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী উচ্চ আদালতে একটি রীট পিটিশন দাখিল করেন। রীট নাম্বার-১৪৩৪/১৯৮৮। যথেষ্ট সময় ক্ষেপণের পর এবং বাংলাদেশের যথেষ্ঠ রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে ১৯৮৮ সালের করা রীট আবেদনের সঙ্গে ২৩ বছর পর অর্থাৎ ২০১১ সালে একটি সম্পূরক আবেদন দাখিল করা হয়। উক্ত সম্পূরক আবেদনের ওপর শুনানি শেষে ওই বছরের ৮ জুন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন।
১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপি বিরোধীদলে থাকলে এতো বড় সাহস এরশাদ পেতেন না। আওয়ামী লীগ বরাবরই গণতন্ত্রপন্থী ও নির্বাচনমুখী একটি দল, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ চেয়েছিল নির্বাচনের ম্যান্ডেটের মাধ্যমে স্বৈরাশাসককে জবাব দিতে। কিন্তু কোন এক দুরভিসন্ধি থেকে অথবা জিয়া হত্যায় ১৩ জনকে ফাঁসিতে ঝুলানোর কৃতজ্ঞতা থেকে হয়তো বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। এই কারণে উনাকে “আপোষহীন নেত্রী” উপাধি দেয় দলের লোকজন। কিন্তু এই তথাকথিত আপোষহীন নেত্রী সেদিন স্বৈরশাসককে যে ক্লিনশিট দিয়েছিল, যেভাবে গণতন্ত্রকামী এরশাদবিরোধী অন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত দলগুলোকে ছেড়ে গিয়েছিল, সেটাই বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে। সেটাই ছিল ৭২’এর সংবিধানের উপর দ্বিতীয় পেরেক, যার প্রথমটি গেঁথেছিলেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। সেই পরিবর্তনের ক্রমধারায় বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, সংগঠন, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, মাদ্রাসাশিক্ষার নামে পাকিস্থানি, তালেবানি, আরবী সংস্কৃতি আমদানী করে আর বাংলাদেশ পিছিয়ে যেতে থাকে।
দীর্ঘমেয়াদী নীলনকশা
ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতির খেলা, যার শুরুটা করেছিলেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। যার পূর্ণতা দিয়েছিল স্বৈরশাসক এরশাদ, তার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী পরবর্তীতে হয়েছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। পূর্বজদের লিগ্যাসিকে সফলভাবে বাংলাদেশের সংবিধান ও জনগণের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁথে দিতে সফলকাম হয়েছিল বিএনপি। যার ক্রমবিবর্তনের ধারায় বাংলাদেশে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, ধর্মবাদ বিস্তৃতি লাভ করেছে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।