গাংনী উপজেলার বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপন করা ডিজিটাল হাজিরা ডিভাইসগুলো বেশিরভাগই এখন বিকল হয়ে আছে। কিছু মেশিন সচল থাকলেও হচ্ছে না এর সঠিক ব্যবহার। প্রায় সাড়ে ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ে কেনা ডিভাইসগুলো এখন পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়।
ডিজিটাল বায়োমেট্রিক শিক্ষক হাজিরা ডিভাইস ক্রয়ে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও মোটা অংকের অর্থ কেলেঙ্কারীর কারনে অল্পদিনেই এগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ। এই অকেজো ডিভাইসগুলো এখন শিক্ষকদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বায়োমেট্রিক হাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রথম পর্বে থাকছে গাংনী উপজেলা নিয়ে। পরবর্তিতে মেহেরপুর সদর ও মুজিবনগর উপজেলার চিত্রও তুলে ধরা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক উপস্থিতি শতভাগ নিশ্চিত করতে ২০১৯ সালে বায়োমেট্রিক হাজিরা চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। ওই বছরই স্থাপন করা হয় গাংনী উপজেলার ১৬২ টি বিদ্যালয়ে বায়োমেট্রিক হাজিরা ডিভাইস। যার খরচ হয়েছে ২৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা। বায়োমেট্রিক হাজিরা ডিভাইস কেনা হয় ১২ হাজার টাকা ও অনলাইন করতে খরচ হয় প্রতিটি মেসিনে ৩ হাজার টাকা।
ডিজিটাল হাজিরা ডিভাইসটি যন্ত্রটি স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যালয়ে সঠিক সময়ে উপস্থিত ও ছুটির সময় শিক্ষকরা হাজিরা মেশিনে আঙুলের ছাপ দেবেন। শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করতেই সরকার এ পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু, বছর না ঘুরতেই জেলার প্রায় ৯০ ভাগ ডিভাইস বিকল হয়ে গেছে। বাকিগুলোর নেই কোনো ব্যবহার।
অভিযোগ আছে, অনেক শিক্ষকই চান না ডিজিটাল হাজিরা মেশিন চালু থাকুক। কারণ প্রায় প্রতিদিনই শিক্ষা অফিসের নাম ভাঙিয়ে অনেক শিক্ষক রাজনৈতিক, সামাজিক অনুষ্ঠান ও ব্যক্তিদের সঙ্গে সময় কাটান। ফলে তাদের মধ্যে অনেকেই এসব মেশিন ইচ্ছেকৃতভাবে অকেজো করে রেখেছেন। এছাড়া কর্তৃপক্ষের উদাসিনতা ও সঠিক তত্ত্বাবধানের কারণেও দীর্ঘদিন ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে বায়োমেট্রিক হাজিরা যন্ত্রগুলো।
করোনার অজুহাত দেখিয়ে শিক্ষকরা বলছেন, করোনায় বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় ডিভাইসগুলো ব্যবহার হয়নি। একই সঙ্গে সফটওয়্যার আপডেট না থাকায় এখন আর ব্যবহার হচ্ছে না।
নাম প্রকাশ না কারার শর্তে একাধিক শিক্ষক বলেন, ‘২০১৯ সালে আমরা স্লিপ ফান্ডের টাকা দিয়ে হাজিরা মেশিন কিনেছিলাম। করোনায় স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর ব্যবহার করা হয়নি। নতুন করে কোনো নির্দেশনা না দেওয়ায় এখন ব্যবহার হচ্ছে না বায়োমেট্রিক হাজিরা। এরমধ্যে যেসব মেশিন সচল রয়েছে সেগুলোতে ডাটা আপডেট না করায় এবং সার্ভারের সঙ্গে ঠিকঠাক কানেকশন না থাকায় অকার্যকর পড়ে আছে। ফলে বাধ্য হয়ে অনেক স্কুলকে এখন ম্যানুয়াল হাজিরা খাতা ব্যবহার করতে হচ্ছে।
গাংনী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পারভেজ সাজ্জাদ রাজা বলেন, ‘যাচাই-বাছাই করেই বায়োমেট্রিক হাজিরা যন্ত্রগুলো কেনা হয়েছে। করোনার কারণে মেশিন চালু করা সম্ভব হয়নি। এরইমধ্যে সামনের ডিসেম্বর মাসে সার্ভিসের মেয়াদও শেষ হবে। তিনি বলেন, এখনো অনেক বিদ্যালয়ে এটি চালু রয়েছে। আমার বিদ্যালয়েও ডিজিটাল ডিভাইস চালু রয়েছে।
এ বিষয়ে গাংনী উপজেলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির একাংশের সভাপতি মহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিক হাফিজুর রহমান বকুল বলেন, ‘শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকারের এটি একটি ভালো উদ্যোগ ছিল। এই উদ্যোগের ফলে সঠিক সময়ে শিক্ষকরা হাজির হবেন। এতে লেখা পড়ার মানোন্নয়নও হতো।
সাবেক শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বায়োমেট্রিক হাজিরা চালু সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এতে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন ও শিক্ষার মানোন্নয়নে ভূমিকা পালন করবে।’ এ শিক্ষকের মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে বায়োমেট্রিক হাজিরা চালু করা হয়েছে এটি যেন লোকদেখানো না হয়ে বাস্তব্যে রূপ দেওয়া হয়। এতে শুধু শিক্ষক হাজিরা নয় বাড়বে শিক্ষার মান। একই সঙ্গে কমবে শিক্ষক অনুপস্থিতির মানসিকতা।’
গাংনী উপজেলা সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নাসির উদ্দীন বলেন, ডিজিটাল ডিভাইসগুলো অধিকাংশই বিকল হয়ে রয়েছে। আমি শিক্ষকদের ডেকে বলেছি তারা যাদের মাধ্যমে এগুলো লাগিয়েছে তাদের ডেকে ঠিক ঠাক করে দিতে। কিন্তু আজও সেটি হয়নি। তিনি আরও বলেন, আমি কোম্পানীর লোককেও ডেকেছিলাম। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ঠিক করে দেওয়ার কিন্তু ঠিক করে দেইনি।
ডিজিটাল এ যন্ত্রটির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন ও শিক্ষার মান উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্টজনরা। তবে নিম্নমানের যন্ত্র ও সঠিক তদারকির অভাবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাই মেশিনগুলো ঠিক করে পুনরায় চালুর দাবি তাদের।