গাংনীতে গত দুই মাসে আইন শৃংখলার চরম অবনতি
গাংনী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক বোমা ও কাফনের কাপড় পাঠিয়ে প্রাণনাশের হুমকী দিচ্ছে দূর্বৃত্তরা। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে চুরি ডাকাতি ছিনতাইয়ের ঘটনায় আতংকিত হয়ে উঠছে গাংনীর জনপদ। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশী ভূমিকা না থাকা ও আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় জনমনে বিরুপ প্রতিক্রিয়া তৈরী হয়েছে। এসব চুরি ডাকাতি ছিনতাই ও বোমা উদ্ধারের ঘটনায় এখনো পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি।
পুলিশের নিস্ক্রিয়তা ও পর্যাপ্ত টহল না থাকায় এই জনপদে, চুরি ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন এলাকাবাসি। তবে পুলিশ বলছে, ৫ তারিখের পর কিছুদিন পুলিশী টহল নিস্ক্রিয় থাকলেও এখন এলাকায় পুরোদমে টহল ও কার্যক্রম চলছে।
তথ্যমতে, গত এক মাসে গাংনী উপজেলার পৃথক পৃথক ৪ টি বসত বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হাত বোমা, কাফনের কাপড়, সাবান, আগরবাতি ও হুমকী সংবলিত চিরকুট রেখেছে দূর্বৃত্তরা। একটি বাড়িতে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় দূর্বৃত্তরা। এছাড়া গত দুই মাসে প্রায় ১০ টিরও বেশি চুরি ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে।
গত সোমবার (২৮ অক্টোবর) সকালের দিকে গাংনী পৌরসভার চৌগাছা গ্রামে বস্তা ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীনের বাড়ির গেট থেকে লালস্কসটেপ মোড়ানো দুটি হাত বোমা, এক টুকরো কাফনের কাপড় এবং প্রাণনাশের হুমকি সম্বলিত একটি চিরকুট উদ্ধার করেছে গাংনী থানা পুলিশ।
ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন জানান, সকালে বাড়ির প্রধান ফটকে লাল স্কচটেপ মোড়ানো দুটি হাতবোমা, এক টুকরো কাফনের কাপড় ও হাতে লেখা প্রাণনাশের হুমকী সম্বলিত একটি চিরকুট দেখতে পান। চিরকুটে দুটি মোবাইল ফোন নম্বর দেয়া আছে যোগাযোগের জন্য। অন্যথায় গুলি করে হত্যা করা হবে বলেও চিরকুটে লেখা হয়। এতে তিনি পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এর আগেও হাতবোমা রেখেছিল দূর্বৃত্তরা।
এর আগে গত মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে গাংনী উপজেলার কড়ইগাছি গ্রামের স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শ্রমিক লীগের রাইপুর ইউনিয়ন শাখার সাধারণ সম্পাদক সুমন আলীর বাড়ির হেসেল ঘরের সামনে থেকে দুটি হাতবোমা, কাফনের কাপড়, সাবান ও আগরবাতি ও দুই পাতার একটি চিরকুট রেখেছিল দূর্বৃত্তরা। পরে শ্রমিক লীগ নেতা সুমন আলী গাংনী থানা পুলিশকে খবর দিলে সেগুলো উদ্ধার করে থানায় নেন।
গত ৩০ আগস্ট রাত ১০টার দিকে গাংনী পৌর শহরের চৌগাছা গ্রামের স্থানীয় বিএনপি কর্মী ও ঔষধ ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম মিঠুর বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে থেকে একটি হাত বোমা, এক টুকরো কাফনের কাপড় ও হত্যা সংবালিত হুমকীর চিরকুট উদ্ধার করা হয়েছিল। তার তিনদিন আগে ২৭ আগস্ট মঙ্গলবার রাতে তার বাড়িতে বোমা হামলা করে দূবৃর্ত্তরা। এসব ঘটনায় ঔষধ ব্যবসায়ী মিঠু ও তার পরিবার আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে দুষ্কৃতিকারীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
এছাড়া গত ১৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সকালে গাংনী উপজেলার গোপালগর বাজারে রাইপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে থেকে দুইটি হাতবোমা, চিরকুট ও একটু টুকরো কাফনের কাপড় উদ্ধার করে পুলিশ।
বিএনপি নেতা রবিউল ইসলাম জানান, আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে বোমা, কাফনের কাপড় ও চিরকুট উদ্ধারের ঘটনায় আমি ও আমার পরিবারের লোকজন এখনো আতংকিত।
গত ৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে মেহেরপুর-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের গাংনী উপজেলার আকুবপুর নামক স্থানে গাছ ফেলে প্রায় ঘণ্টা ধরে গণডাকাতি করে ডাকাতরা। এসময় দুরপাল্লার শ্যামলী পরিবহনের একটি যাত্রীবাহি বাসসহ বেশ কয়েকটি যানবাহনে গণডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডাকাতরা পথচারী, যাত্রী ও কয়েকজন পরিবহনচালককে কুপিয়ে জখমের পাশাপাশি মারধর করে স্বর্ণালংকার ও অর্থ লুট করেছে। ডাকাতদের হামলায় যাত্রীবাহী যানবাহনের চালক, তাঁর সহকারীসহ কয়েকজন আহত হয়েছেন।
এ ঘটনায় দুজন গুরুতর আহত হন। তাঁরা হলেন শ্যামলী পরিবহনের চালক মোস্তাফিজুর রহমান (৫০) ও তাঁর সহকারী রহিদুল ইসলাম (৩৩)।
আহত অবস্থায় তাঁদের প্রথমে গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
আহতরা জানান, ২০ থেকে ২২ জনের একটি ডাকাত দল সড়কের ওপর গাছ ফেলে পরিবহনের গতিরোধ করে ডাকাতি শুরু করে। এসময় বাধা দিলে চালকের সহকারী রহিদুল ইসলাম ও চালক মোস্তাফিজুর রহমানকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। এসময় যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা, স্বর্ণালংকার ও মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে যায়। এসময় সড়কে যাতায়াত করা অ্যাম্বুলেন্স, মাইক্রোবাস, আলগামন, নছিমনসহ বেশ কয়েকটি গাড়ির গতি রোধ করেন ডাকাত দলের সদস্যরা।
এছাড়া গত ৬ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে ৮টার দিকে গাংনী উপজেলার করমদি-ভোমরদহ রাস্তার চোরপোতা ভিটাপাড়া এলাকায় ঔষধ কোম্পানির দুই বিক্রয় প্রতিনিধির (রিপ্রেজেন্টেটিভ) বোমা হামলা ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নগদ ২০ হাজার টাকা ও একটি মোটরসাইকেল ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা।
এ ঘটনায় গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির (ভেটেরিনারি) প্রমোশন অফিসার মাজেদুল ইসলাম (৩৫) ও ইথিক্যাল ড্রাগস কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি মিরাজ আলী (৩৮) গুরুতর আহত হয়েছেন।
আহত জানান, তাঁরা সীমান্তবর্তী তেঁতুলবাড়িয়া, করমদি, পলাশীপাড়া এলাকা থেকে ঔষধ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা উত্তোলন করে মোটরসাইকেলযোগে গাংনী ফিরছিলেন। তেঁতুলবাড়িয়া থেকে ভোমরদহ রাস্তা দিয়ে চোরপোতা এলাকায় পৌঁছালে ৬/৭ জনের একদল সশস্ত্র ছিনতাইকারী তাদের পথরোধ করে। মোটরসাইকেলের চাবি কেড়ে নিতে চায়। চাবি দিতে না চাওয়ায় প্রথমে হাতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপ মারে। পরে হাতে একটি বোমা মারে। বোমা ও অস্ত্রের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে পকেটে থাকা ২০ হাজার টাকা ও একটি মোটরসাইকেল ছিনতাই করে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আটটার দিকে গাংনী-হাটবোয়ালিয়া সড়কের বাথানপাড়া-রাইপুর মাঠের মধ্যে ১৮/২০ টি মোটরসাইকেল ও একটি অটোভ্যান থামিয়ে গণছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এঘটনায় নগদ এক লক্ষ টাকাসহ ১৫/১৬ টি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানান ভুক্তভোগীরা। ভুক্তভোগীরা জানান, হাটবোয়ালিয়া থেকে বাড়ি ফিরতে বাথানপাড়া-রাইপুর গ্রামের মাঝামাঝি স্থানে পৌঁছলে, ১০/১৫ জনের একটি দল রামদা, লাঠিসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে। এসময় চোখ ও হাত পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে প্রায় ২০/২২ পথচারির কাছ থেকে মোবাইলফোন, নগদ টাকাসহ স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেই।
এসময় দুই নারীর কাছ থেকে নগদ টাকা ছিনিয়ে নেই ছিনতাইকারীরা, জানান তারা। ছিনতাইকারীরা পথচারিদের চোখ বেঁধে ধনচে ক্ষেতের মধ্যে রাত ৯ টা পর্যন্ত আটকিয়ে রাখে বলে জানান ভুক্তভোগীরা। এসময় একজনকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। তথ্য মতে, গত সেপ্টেম্বর মাসের বোমা হামলা, চুরি ও ছিনতাইয়ের ৮টি ঘটনা ঘটে।
গত ৬ সেপ্টেম্বর গাংনী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে থেকে কাজীপুর গ্রামের মাসুদ রানার একটি পালসার মোটরসাইকেল চুরি হয় যার নম্বর মেহেরপুর ল ১১-৪৬১২।
৯ সেপ্টেম্বর চিৎলা মাঠের মধ্যে থেকে এক পথচারির কাছ থেকে একটি মোটরসাইকেল ছিনতাই হয়। ১৩ সেপ্টেম্বর হাড়াভাঙ্গা গ্রামে আজাদের বাড়ি থেকে একটি গরু চুরির ঘটনা ঘটে। এসময় জনতার হাতে একজন চোর আটক হয়। একই রাতে মটমুড়া গ্রামে দোকান ভেঙ্গে দোকানের মালামাল চুরির ঘটনা ঘটে। ২০ সেপ্টেম্বর বাওট বাজার থেকে চুরি হয় একটি এ্যাপাচি আরটিয়ার মোটরসাইকেল। যার নম্বর কুষ্টিয়া ল ১২-৫০০১।
স্থানীয়রা জানান, আগে এলাকায় পুলিশি টহল থাকার কারনে চুরি ডাকাতি ও ছিনতাই ছিলনা। গভীর রাতেও মানুষ রাস্তাঘাটে চলাচল করতো। এখন সন্ধ্যার আগেই রাস্তাঘাট জনশুন্য হয়ে পড়ে। রাস্তায় বের হলেও পড়তে হচ্ছে ডাকাত ও ছিনতাইকারীদের কবলে। গুরুত্বপুর্ণ কোন কাজে যাবার প্রয়োজন হলেও মানুষ যেতে পারছেননা।
এনিয়ে গত এক মাসে গাংনী উপজেলার পৃথক চারটি স্থানে হাতবোমা, কাফনের কাপড় ও চিরকুট রেখে গেছে দূর্বৃত্তরা। চুরি ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ডর্জনখানেক। একের পর এক বোমা, কাফনের কাপড় ও হুমকীর সংবলিত চিরকুট উদ্ধারের ঘটনায় জনমতে চরম আতংক বিরাজ করছে বলে জানান স্থানীয়রা।
এসব ঘটনায় আজো কেউ আটক হয়নি। উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি চুরি ও ডাকাতি করা মালামাল। গত সেপ্টেম্বর ও চলতি আগষ্ট মাসে আরো কয়েকটি ছিনতাই ও চুরির ঘটনা ছাড়াও চলেছে নীরব চাঁদাবাজি। ভয়ে ভুক্তভোগিরা নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে কেউ পুলিশের কাছে অভিযোগ করেনি।
এলাকাবাসির অভিযোগ আগে মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের গাংনী উপজেলার আকবপুর নামক এলাকায় রাত ৯ টা থেকে ভোররাত পুলিশের টহল থাকত। এখন রাতের বেলায় আগের মত পুলিশ দেখা যায় না। এ কারণে দুস্কৃতিকারীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
গাংনী উপজেলার বেশ কয়েকটি পুলিশ ক্যাম্প থাকলেও গত ৫ আগস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর পুলিশ ফাড়ির পুলিশ একরকম নিষিক্রয় হয়ে পড়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে দুষ্কৃতিকারীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসি।
গাংনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বনী ইসরাইল জানান, গাংনীর বিভিন্ন এলাকায় এখন পুলিশের দৃশ্যমান উপস্থিতি আছে। আমরা এখন জনগণের সেবায় সার্বক্ষনিক নিয়োজিত আছি। বিভিন্ন ঘটনায় তদন্ত ও আসামিদের ধরতে পুলিশের অভিযানও শুরু হয়েছে।
এবিষয়ে মেহেরপুর এডিশনাল এসপি সার্কেল আব্দুল করিম বলেন, বিগত ৫ তারিখের পর কিছুদিন পুলিশের তৎপরতা কম থাকলেও এখন পুলিশী টহল এবং কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। চুরি ডাকাতির কোনো ঘটনায় আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। তবে, বোমা, কাফনের কাপড় বা অন্যান্য ঘটনাগুলোতে পুলিশের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চলছে। গাংনীর বিভিন্ন এলাকায় অপরাধীদের আটকের জন্য অভিযান চালছে। আতংকিত না হয়ে পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগীতার আহবান জানান তিনি।