বৈজ্ঞানিক হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে কেবল শ্রীমঙ্গল আর ঈশ্বরদীতে শৈত্যপ্রবাহ চলছে। বুধবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল শ্রীমঙ্গলে।
আর ঈশ্বরদীতে ছিল ১০ ডিগ্রি। এছাড়া আর কোথাও শৈত্যপ্রবাহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে না। কিন্তু এরপরও অনুভূত হচ্ছে বেজায় শীত।
শীতল সমীরণ, যা হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। ঢাকায় মঙ্গলবারের তুলনায় বুধবার শীতের অনুভূতিও বেশি ছিল। কনকনে শীতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।
বিশেষ করে খেটে খাওয়া ও অসহায় মানুষের দুর্ভোগের সীমা নেই। শীত নিবারণে মানুষকে বিভিন্ন স্থানে আগুন পোহাতে দেখা গেছে। পাশাপাশি বেড়েছে সোয়েটার, জ্যাকেট, শাল-চাদর, মাফলার-কানটুপিসহ গরম জামা-কাপড়ের কদর। ফলে বাজারে গরম পোশাকের চাহিদা বেড়েছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
কিন্তু এমন অবস্থা কেন-এই প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) আবহাওয়াবিদ খোন্দকার হাফিজুর রহমান বলেন, শৈত্যপ্রবাহ না থাকলেও তীব্র শীত অনুভবের কয়েকটি কারণ থাকতে পারে।
এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাতাসের গতি এবং সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পার্থক্য ১০ ডিগ্রির নিচে নেমে যাওয়া।
এছাড়া কুয়াশার প্রকোপ, সূর্যের স্বল্পস্থায়ী কিরণকাল কিংবা একেবারেই সূর্যের মুখ দেখতে না পাওয়ার ওপরও শীতের তীব্রতা নির্ভর করে।
বাতাসের গতি বেশি থাকলেও শীতের অনুভূতি ও প্রকোপ বেশি মনে হয়। বর্তমানে প্রকৃতিতে এ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সাধারণত শীতে সবচেয়ে বেশি কাবু হয়ে থাকে বয়স্ক মানুষ এবং শিশুরা। অনেকেই এই সময়ে শীতজনিত ডায়রিয়া, সর্দি-জ্বর প্রভৃতিতে ভুগে থাকে। শীতের উল্লিখিত পরিস্থিতির মধ্যেই আবার বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে মৌসুমি লঘুচাপ। দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরের এই লঘুচাপের বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। এছাড়া উপমহাদেশীয় উচ্চচাপবলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশে অবস্থান করছে।
এসব বাহ্যিক কারণও শীতের অনুভূতি বাড়িয়ে দিয়েছে। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণও বেশি। অন্যদিকে শীতের পাশাপাশি বেড়েছে কুয়াশার প্রকোপ। রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ এলাকায় দিনেও হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কুয়াশা দেখা যাচ্ছে। বুধবার সারা দিন দেখা যায়নি সূর্যের মুখ। ফলে সন্ধ্যায় কুয়াশার ঘনত্ব আরও বেড়ে যায়।
বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে দিনেও ঘন কুয়াশা দেখা যায়। দৃষ্টিসীমা কমে আশায় দুর্ঘটনা এড়াতে ঢাকার বাইরে দিনেও হেডলাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করছে নৌযান। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়ায় ৬ ঘণ্টা ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল। এছাড়া ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কুয়াশার কারণে বিমান ওঠানামায় বিঘ্ন ঘটে। যুগান্তর প্রতিনিধি এবং বিএমডি সংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক যুগান্তরকে বলেন, শৈত্যপ্রবাহ না হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে কনকনে শীত অনুভবের চারটি কারণ আছে। এগুলো হলো-মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, সূর্যের স্বল্পস্থায়ী কিরণকাল, কুয়াশার প্রকোপ এবং সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার কম পার্থক্য। তিনি দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন, ঢাকায় বুধবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ১৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উভয়ের পার্থক্য মাত্র সাড়ে ৫ ডিগ্রি। ১০ ডিগ্রির নিচে সর্বোচ্চ আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য যত কমবে, শীতের অনুভূতি তত বেশি হবে। তিনি আরও বলেন, লঘুচাপ পরিস্থিতির কারণে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। মেঘে ঢাকা আকাশ সূর্যের কিরণ ভূপৃষ্ঠে পৌঁছাতে বাধা দেয়।
আবহাওয়াবিদদের মতে, তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নামলে এবং ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলে। এছাড়া ৬ থেকে ৮ ডিগ্রিতে নেমে এলে তা মাঝারি আকারের এবং এর নিচে নামলে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। বর্তমানে দেশের দুটি এলাকা শৈত্যপ্রবাহভুক্ত হলেও আগামী কয়েকদিনে এ হাড় কাঁপানো শীতের প্রকোপ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিএমডি। কেননা বঙ্গোপসাগরের লঘুচাপের কারণে জলীয় বাষ্প দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমদিক থেকে লঘুচাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এতে বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা আছে। আর তেমনটি হলে শীতের প্রকোপ আরও বাড়বে।
এদিকে বিএমডি ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে জানিয়েছে, সারা দেশে রাত ও দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। বিশেষ করে দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে যাওয়ায় দেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মাঝারি থেকে তীব্র শীতের অনুভূতি অব্যাহত থাকতে পারে। পূর্বাভাসে বলা হয়, মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারা দেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে এবং এটি দেশের কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
রাজবাড়ী : দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে মঙ্গলবার রাত ৩টা থেকে ঘন কুয়াশার কারণে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কুয়াশার ঘনত্ব কমে গেলে বুধবার সকাল ৯টা থেকে পুনরায় ফেরি চলাচল শুরু হয়। বিআইডব্লিউটিসির দৌলতদিয়া ঘাট শাখার ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সালাহউদ্দীন এ তথ্য জানিয়েছেন। দৌলতদিয়া ৫ নম্বর ফেরিঘাটের মাছ ব্যবসায়ী মোমিন সেখ বলেন, ভোর থেকে প্রচুর কুয়াশা ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। মহাসড়কে যানবাহনগুলো হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করেছে।
সিলেট : সিলেট বিভাগজুড়ে লেগেছে পৌষের শীতের কাঁপন। বিশেষ করে মৌলভীবাজারের পাহাড়ি এলাকা ও সুনামগঞ্জের হাওড়াঞ্চলের অসহায়, দরিদ্র জনগোষ্ঠী চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। চা-বাগানের শ্রমিক, হাওড়াঞ্চলের জেলে, কৃষক ও শ্রমজীবী লোকজন শীত উপেক্ষা করেই সকালে কাজের তাগিদে ঘর থেকে বের হন। এসব শ্রমজীবী মানুষের খোঁজ নিচ্ছেন না স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার থেকে শুরু করে সংসদ-সদস্যরাও ভুলে গেছেন তাদের এই দুর্ভোগের কথা। কিছু কিছু জনপ্রতিনিধি বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংস্থা প্রদত্ত শীতবস্ত্র বিতরণে অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকলেও তারা নিজেদের উদ্যোগে কোথাও শীতবস্ত্র নিয়ে শীতার্তদের পাশে দাঁড়াননি।
শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) : শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান জানান, বুধবার সকাল ৯টায় শ্রীমঙ্গলে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে, যা দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা?। এছাড়া শ্রীমঙ্গল ও আশপাশের এলাকায় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যায়। পর্যাপ্ত গরম কাপড়ের অভাবে নিম্ন-আয়ের মানুষসহ চা-বাগানের শ্রমিকরা কষ্টে আছেন।
কোটালীপাড়া (গোপালগঞ্জ) : তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় সাধারণ মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। চরম দুর্ভোগে পড়েছেন দীনমজুর ও নিম্ন-আয়ের মানুষ। ব্যাহত হচ্ছে বোরো আবাদ। উপজেলার কুরপালা গ্রামের হালিম শিকদার বলেন, ভ্যান চালিয়ে আমি আমার সংসার চালাই। দুই দিন ধরে প্রচণ্ড শীত ও কুয়াশার কারণে ভ্যান চালাতে পারছি না। এভাবে চলতে থাকলে আর দুই-একদিন পর আমার সংসার চালানো সম্ভব হবে না।
সূ্ত্র:যুগান্তর