মেহেরপুর সদর উপজেলার প্রাণি সম্পদ অফিসের ভেটেরিনারি সার্জন ডাঃ সৈয়দ ছাকিবুল ইসলামের বিরুদ্ধে নানা ধরনের দুর্নীতির নানা অভিযোগ উঠেছে।
এক্সপোজার ভিজিটের টাকা আত্মসাৎ, সরকারি ডরমেটরি কর্মচারির নামে বরাদ্দ নিয়ে নিজে বসবাস, জরুরী সেবায় ব্যবহৃত এমভিসি গাড়িটি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার, চিকিৎসা সেবা প্রদান করে খামারীদের কাছ থেকে অর্থ নেয়া, নিজে চিকিৎসা না দিয়ে বহিরাগতদের দিয়ে প্রতিদিন হাসপাতালে চিকিৎসা প্রদানসহ সীমাহিন অনিয়ম ও দুর্ব্যবহারে ভুক্তভোগীরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
ডা. সৈয়দ ছাকিবুল ইসলাম ২০২১ সালে ভেটেরিনারি সার্জন হিসেবে মেহেরপুর সদর উপজেলা প্রাণি সম্পদ অফিসে যোগদান করেন । বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্বে আছেন।
মেহেরপুর সদর উপজেলা প্রাণি সম্পদ দফতর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে এক্সপোজার ভিজিট বাবদ বরাদ্দ এসেছে ১১ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ টাকা। এক্সপোজার ভিজিট বলতে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য এক দল খামারিকে তাদের এলাকা থেকে অন্য এলাকার একটি খামার পরিদর্শনকে বোঝায়। অন্য এলাকার খামারিরা যেসব নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন বা উন্নয়ন সাধন করেছেন বা গবেষণা কেন্দ্রে বা খামারে যেসব প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে সেসব কার্যক্রম ভিজিটের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকার খামারিদের প্রদর্শন ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করানো হয়। এ বিষয়ে ব্যয় বাবদ অংশগ্রহণকারীদের ভাতা, এলএসপি ভাতা, ভিএস/ইউএলওদের সম্মানি, পরিবহন খরচ এবং খাবার বাবদ খরচ হয়ে থাকে। ৬৩০ জনের উপর এই ব্যয় হবার কথা এবং দায়িত্বরত অফিসার ১টি ভিজিটের জন্য সম্মানি হিসেবে ১ হাজার টাকা করে পাবেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই প্রকল্পে মোট ৫টি এক্সপোজার ভিজিট সম্পন্ন হয়েছে। চলতি বছর ৬ জুলাই ১ম ভিজিটে চুয়াডাঙ্গা জেলার কুলপালায় হাস খামারে ব্যয় হয়েছে ১০০ জনের বিপরীতে ১ লাখ ৬২ টাকা। ২ জুলাই ২য় ভিজিটে চুয়াডাঙ্গার কোষাঘাটা ওয়েভ ফাউন্ডেশনের ছাগল খামারে ব্যয় হয়েছে ১৪০ জনের বিপরীতে ১ লাখ ৪২ হাজার ৮৪৫ টাকা। ৪ জুলাই ৩য় ভিজিটে দামুড়হুদা পোড়াপাড়ার রাজা এগ্রো ফার্মে ব্যয় হয়েছে ১১০ জনের বিপরীতে ১ লাখ ১২ হাজার ৩৮০ টাকা। ৮ জুলাই ৪র্থ ভিজিটে বারাদি, আলমডাঙ্গার বারাদিতে তাহাজুদ্দিন এগ্রোতে ব্যয় হয়েছে ১২০ জনের বিপরীতে ১ লাখ ২৩ হাজার ৪৩০ টাকা। ১০ জুলাই ৫ম ভিজিটে কুষ্টিয়ার মিরপুরে দিশা এগ্রো ফার্মে ব্যয় হয়েছে ১৬০ জনের বিপরীতে ১ লাখ ৬২হ হাজার ৯৬০ টাকা। ৫টি ভিজিটে ব্যয় ৬ লাখ ৪১ হাজার ৬৪৭ টাকা। অবশিষ্ট ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৫৫৩ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে ভেটেরিনারি সার্জন ডাঃ ছাকিবুল ইসলামের বিরুদ্ধে। জানা গেছে, তিনি গত ১৩ জুন মেহেরপুর সোনালি ব্যাংক থেকে বরাদ্দের ১১ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ টাকা একসাথে উত্তোলন করেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, পশু-পাখির জন্য ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা ক্লিনিকের জন্য এমভিসি নামক একটি ডাবল কেবিন পিকআপ আছে। দ্রুততম সময়ে খামারিদের দোরগোড়ায় জরুরী চিকিৎসাসেবা পৌছানোর জন্য এই গাড়িটি ব্যবহার হয়ে থাকে। খামারিরা বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা পাওয়ার কথা। এর জন্য গাড়িটির একটি হটলাইন নাম্বার ১৬৩৫৮ রয়েছে। এখানে ফোন করে তাৎক্ষণিক সেবা পাওয়া সম্ভব। ভেটেরিনারি সার্জন ডাঃ ছাকিবুল ইসলাম এই গাড়ি ব্যবহার করে খামারিদের সেবা দিচ্ছেন, বিনিময়ে অর্থ নিচ্ছেন নিয়মিত।
মেহেরপুর সদর উপজেলার উত্তর শালিকা গ্রামের খামারি সাইফুল ইসলামের কাছে থেকে সেবা দিয়ে টাকা দাবি করেছেন ২২০০ টাকা। খামারি তাকে দিয়েছেন ২০০০ টাকা। একইভাবে শুভরাজপুরের সিরাজের ছেলে খামারি মনিরুল দিয়েছেন ৩৫০০ টাকা। একই গ্রামের ঝন্টু মিয়ার ছেলে খামারি তাহেরের কাছ থেকে ৪০০০ টাকা, একই গ্রামের সিরাজের ছেলে খামারি আমিরুলের কাছ থেকে ২ কিস্তিতে ৩০০০ টাকা, হরিরামপুর গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে খামারি শুভ’র কাছ থেকে ২ মাস আগে ৫ হাজার টাকাসহ আরো অনেকের কাছ থেকে চিকিৎসা বাবদ টাকা নিয়েছেন।
জানা গেছে, প্রাণি সম্পদ সদর অফিসের ২য় তলায় ডরমেটরি আছে। কর্মকর্তা-কর্মচারিরা বেতনের বাড়ি ভাড়া অংশের ২৫ শতাংশ টাকার বিনিময়ে রুম ভাড়া নিতে পারেন। ভেটেরিনারি সার্জনের মূল বেতন বেশি হওয়ায় নিজের নামে ডরমেটরি ভাড়া না নিয়ে কর্মচারি নাজমুল হক (ভিএফএ) এর নামে ১টি রুম বরাদ্দ দেখিয়ে ২টি রুম ফ্যামিলি নিয়ে ব্যবহার করছেন। অফিস সহকারি আজহারুল ইসলাম বলেন, প্রতি মাসে নাজমুল হক (ভিএফএ) ১২০৪ টাকা ডরমেটরির ১টি রুমের ভাড়া বাবদ সোনালি ব্যাংক প্রধান শাখায় চালানের মাধ্যমে জমা দেন। সেখানে ২টি রুম নিয়ে পরিবারসহ বসবাস করছেন ডাঃ সার্জন ছাকিবুল ইসলাম।
সরেজমিনে দেখা যায়, কোনো প্রকার চিকিৎসা সম্পর্কিত ডিগ্রী না থাকা সত্ত্বেও প্রাণি সম্পদ হাসপাতালের আউটডোরে প্রেসক্রিপশন লিখছেন, বিভিন্ন ধরনের অপারেশন করছেন এবং রেজিস্টার খাতা লিখছেন। রোগীর মালিকের নাম, রোগের বিবরণ এবং চিকিৎসা রেজিস্টার খাতায় লিখতে হয়। সেই খাতাটিও বহিরাগতদের দিয়ে করানো হচ্ছে। যা ভেটেরনারি সার্জনের কাছে রেজিস্টার খাতা থাকার কথা। নাজমুল, জনি রাহা, মুফাক্ষেরসহ বহিরাগত আরো অনেকে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন। সাংবাদিক দেখে অনেকেই দৌড়ে পালিয়ে যান। উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা (ইউএলও) ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও নেমপ্লেটে ভারপ্রাপ্ত শব্দটি না লিখে প্রতারণা করছেন ডাঃ ছাকিবুল ইসলাম। এছাড়াও তার চেম্বারের পুরো টেবিলটিতে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানী থেকে দেওয়া ওষুধের নাম সম্বলিত সিল রাখা হয়েছে।
অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে ভেটেরিনারি সার্জন ডাঃ ছাকিবুল ইসলাম সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সবকিছু নিয়মের মধ্যে করা হয়েছে। অন্যান্য প্রকল্পের তথ্য চাওয়া হলে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করতে বলেন তিনি।
এ বিষয়ে জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ দেবেন্দ্র নাথ সরকার (অ.দা.) বলেন, সদর ভেটেরিনারি সার্জন ডা. ছাকিবুল ইসলামের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।