মানুষের ৪টি মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম হলো খাদ্য। বিশেষ করে মানব দেহের বৃদ্ধি গঠন ও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে খাদ্য অপরিহার্য।
তবে চলমান শতাব্দীতে সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তা ছাড়া সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা ও দেহকে কর্মক্ষম, চলনসই রাখার জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প নেই। তাই সকলের উচিত খাদ্য তালিকায় আমিষ, শর্করা, স্নেহ, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি এই সবগুলো উপাদান নিশ্চিত করা।
যাকে বলা হয় সুষম খাবার। তাই শুধু পেট ভরার জন্য খাওয়া এই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে নিরাপদ ও পুষ্টিমান সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন,দেশে দেশে যুদ্ধ, সংঘাত, মরুময়তা,লবণাক্ততায় বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপদনে সংকটকাল অতিবাহিত করছে। তাছাড়া করোনা অতিমারির ভয়াবহতা, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতে মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি সংকটে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্ব দুঃসহ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বৈশ্বিক খাদ্য সংকটে বিশ্বের অনেক দেশ বিপর্যস্ত। উৎপাদন পরিস্থিতি বিবেচনায় এবং চলমান সংকটের কারণে ২০২৩ সালে সারা বিশ্বে খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষ অত্যাসন্ন বলেছেন সংস্থা। বাস্তবে সুদান, সোমালিয়াসহ বিশ্বের বেশ কয়েটি দেশে খাদ্যের জন্য মানুষের আহাজারি, নারী শিশুর মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ব।
অবশ্য খাদ্য সংকটের বৈশ্বিক অবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশে মিল নেই। জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্য অন্যতম এবং এটা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু এ অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে নানা মুখীসংকট বিরাজ করছে। এরমধ্যেও গত কয়েক দশকে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চাষযোগ্য জমি সংরক্ষণ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, কৃত্রিম বনায়ন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি কর্মকা মাধ্যমে বিশ্বের সব দেশ ব্যস্ত খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। এমন এক প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বে পালিত হয় বিশ্ব খাদ্য দিবস। বিগত সময়ে করোনাভাইরাস মহামারিতে কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থা ব্যাহত করেছে এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি করেছে। ফলে জীবিকা ও আয় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা ও
বৈষম্যও বেড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে উন্নত উৎপাদন, উন্নত পুষ্টি, উন্নত পরিবেশ ও উন্নত জীবনযাত্রার জন্য আরো দক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমুলক, স্থিতিশীল ও টেকসই কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থায় রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো, যাতে কেউ পিছিয়ে না থাকে। আমাদের কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থাও এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন সবার জন্য পর্যাপ্ত সাশ্রয়ী, পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
বর্তমান অবস্থার প্রতিপ্রেক্ষিতে ও আন্তর্জাতিক খাদ্যবাজারে অস্থিরতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সংকটকালে খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের জন্য কৃষিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ ও সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং জনসচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের খাদ্য আমাদেরই উৎপাদন করতে হবে। দেশের মাটি, পানি, প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার এবং নিজস্ব প্রচেষ্টার মাধ্যমেই তা করতে হবে। পরিবর্তিত জলবায়ুতে খাপ খাইয়ে উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে।
একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য খাদ্যমূল্য নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। আবার সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য। আর এ বিশুদ্ধ খাদ্যই যদি অখাদ্যে রূপান্তরিত হয়, তা গ্রহণের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। এ খাদ্য যদি আমাদের জীবন-জীবিকার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে আমরা যে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির শিকার হব তা কিন্তু যুদ্ধ ও মহামারীর ভয়াবহতার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কাজেই এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করা এখন সময়ের দাবি।
প্রসঙ্গত: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গত দেড় বছর ধরে বিশ্ব সর্বোচ্চ খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। এমনি অবস্থায় জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত খাদ্য সংকটের ইঙ্গিত তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থাসহ সবাই একযোগে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন, ফিলিস্তিনে ইসরাইলে আগ্রাসনের কারণে হতে যাওয়া এ ভয়াবহ খাদ্য সংকটের ফলে শুধু ইউক্রেন,ফিলিস্তিনই নয়; হাজার হাজার মাইল দূরবর্তী দেশগুলোর মানুষেরও মৃত্যুর আশঙ্কা করছে এসব আন্তর্জাকিত সংস্থাসমূহ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সংশোধিত বার্ষিক পূর্বাভাসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পাশাপাশি নানাবিধ কারণে বর্তমান বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ফলে সংস্থাটি ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য কমার ইঙ্গিত দিয়েছে,যা বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে। উপরন্তু জ্বালানি, খাদ্য ও সারের আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়া বিশ্বজুড়ে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণ
সংকট বাড়াচ্ছে।
অন্যদিকে, জানুয়ারিতে জার্মানির বার্লিনে অনুষ্ঠিত ১৫তম কৃষিমন্ত্রীদের সম্মেলনে বিদ্যমান খাদ্য সংকট পরিস্থিতিতে সংকটকালীন খাদ্যব্যবস্থা, জলবায়ু সহনশীল খাদ্য, জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং টেকসই বৈশ্বিক খাদ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তাতে আরো বলা হয়, অদূর ভবিষ্যতে একটি অত্যন্ত দুর্যোগময় সময় এগিয়ে আসার এবং বিশ্বে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। ‘ঘূর্ণিঝড় রিমাল পরবর্তী খাদ্য নিরাপত্তা : আশু করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে বাপা’র পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে খুলনা সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলায় ৬১ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ওই বাঁধগুলি মেরামত করতে হবে।
জনগণকে সম্পৃক্ত করে জনগণের মালিকানায় বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে নীতি ও কৌশল পরিবর্তন করতে হবে। তারা বলেন, ‘সুন্দরবন বুক পেতে যদি আমাদের রক্ষা না করতো তাহলে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি আরো বেশি হতো। সুন্দরবন আমাদের রক্ষা করছে; সুন্দরবনকে রক্ষা করবে কে? সুন্দরবনের উপর যদি মানুষ অত্যাচার না করে তাহলে সুন্দরবন নিজ থেকেই এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠবে বলে বিশ্বাস করি।, ঘূর্ণিঝড় প্রভাবে উপকূলে সুপেয় পানির সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আগামীতে আমন ধান চাষ, পাট ও শাক সবজি চাষে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার জন্য নতুন মাত্রায় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে দেশের উপকূলীয় জেলা উপজেলা সমুহে পানিতে অধিক মাত্রায় লবণাক্ততা,আবার কোথাও কোথাও মরুময়তা। এমনি অবস্থায় বাংলাদেশে সকলের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত চ্যালিঞ্জিং। অবশ্য সকলের জন্য খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকার ইতোমধ্যে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এমনি অবস্থায় সরকারের পক্ষে সম্ভাব্য খাদ্যসংকট মোকাবিলা করে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমুদ্র উপকূলবর্তী মিঠাপানির জলাশয় থেকে দ্রুত লবণাক্ত পানি অপসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, সদ্য ঘূর্ণিঝড় রিমালে দেশের সমুদ্র উপকূলে আঘাত হানার পর থেকে প্রায় ৫০ ঘণ্টা অবস্থান করেছে। এতে বাঁধ উপচে লোকালয়ে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করেছে। তাছাড়া সমুদ্রের জোয়ারের পানিতে লবণ বয়ে এনে তা উপকূলের পুকুরে,জলাশয়ের পানিকে লবণাক্ত করে তোলে। যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং খাদ্য সংকটের বৈশ্বিক সমস্যার সঙ্গে বাংলাদেশে এই
পরিস্থিতিকে আরো সংকটে ফেলছে।
দেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের পানিতে ,মাটিতে অধিক মাত্রায় লবণাক্ততা এবং দেশের উত্তরাঞ্চেলের ১৬ জেলায় বিরাজমান মরুময়তা। কারণ উপকূলের মাটি পানিতে লবণাক্ততায় খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয় মারাত্মক ভাবে। একই ভাবে দেশের উত্তরাঞ্চেরের ১৬ জেলায় গ্রীষ্মে অতিমাত্রায় মরুময়তায় খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয় সমভাবে। অবশ্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একাধিক স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ফোরামে বক্তব্য কালে সম্ভাব্য এ বৈশ্বিক মন্দা বা দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশবাসীকে প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছিলেন খাদ্য চাহিদা পূরণ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অনাবাদি সব জমিকে আবাদের আওতায় আপনা,উৎপাদনস বৃদ্ধি,উৎপানে বৈচিত্র্য আনায়নের। এমনি অবস্থায় , দেশের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় ১৭টি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক হবে এমনি প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট মহলের।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষিমন্ত্রণালয় তার আওতাধীন সংস্থাসমূহের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন খরচ কমানো, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, আবাদি জমি বাড়ানো, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন, জলবায়ু পরিবর্তন উপযোগী প্রযুক্তি ও ফসল উদ্ভাবন, আন্তফসল, মিশ্র ফসল, রিলেফসল, রেটুন ফসল চাষ করা, সেচের জমি বৃদ্ধি করা, উফশী ও হাইব্রিড ফসল চাষ করা, শস্য বহুমুখীকরণ করা, জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত ও প্রচুর চারা উৎপাদন করা, রোগবালাই দমন করা। প্রতি ইঞ্চি জমি চাষ করা। ধানক্ষেতে মাছ চাষ, পুকুরে মাছ-মুরগি-হাঁসের সমন্বিত চাষ করা, রোগ ও পোকা দমনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা, সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া, পশুপাখির জন্য জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভর্তুকি বাড়ানো, সংরক্ষণাগার বাড়ানো, কৃষি উপকরণ সরবরাহ, শস্যবিমা চালু করা ও পতিত জলাশয়ে মাছ চাষের বহুমুখী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রত্যাশা সরকারি উদ্যোগে গৃহীত এসব কর্মসূচি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন এবং খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, রিনাপদ খাদ্যেও নিশ্চয়তা করণীয় সম্পর্কে ব্যাপক হারে জনসচেতসতা সৃষ্টি,খাদ্যের অপচয় রোধে সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে যথাযথ ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। তাহলেই সম্ভব সকালের জন্য খাদ্যের নিশ্চয়তা এবং নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তার বিধান করা।
# পিআইডি ফিচার
লেখিকা : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত।