জনবল ও চিকিৎসক সংকটে জোড়াতালি দিয়ে চলছে মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলা স্বস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা সেবা। প্রায় চার লক্ষাধিক মানুষের চিকিৎসার একমাত্র ভরসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকট থাকায় কাঙ্খিত চিকিৎসা পাচ্ছেননা এমন অভিযোগ উপজেলাবাসীর। জনবল সংকটের কারনে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি চলছে জোড়াতালি দিয়ে। চিকিৎসা দিতে গিয়েও হাপিয়ে উঠছেন চিকিৎসকরা। অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার থাকলেও ডাক্তারের অভাবে তা বন্ধ। ফলে কোন কাজে আসছেনা প্রায় কোটি টাকা মুল্যেও অপারেশন থিয়েটার। তবে কর্তৃপক্ষ বলছেন এ সমস্যার সমাধান খুঁজে পাচ্ছিনা। অনেক কষ্ট করেই চালাতে হচ্ছে চিকিৎসা কার্যক্রম।
জানা গেছে, মেহেরপুরের তিনটি উপজেলার সবচেয়ে জনবহুল উপজেলা গাংনীবাসীকে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করনের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু সে মোতাবেক জনবল ও চিকিৎসক দেয়া হয়নি।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে ১০ জন জুনিয়র কনসালটেন্ট সহ মোট ২১ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও এ হাসপাতালে রয়েছেন মাত্র ১১ জন। যদিও খাতা-কলমে দায়িত্ব পালন করছেন ১২ জন। জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জিক্যাল) একজন মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে ডেপুটিশনে রয়েছেন।
এছাড়াও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দু’টি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন জেনারেটর থাকলেও তা বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন। বিদ্যুৎ চলে গেলেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হয়ে ওঠে অন্ধকারচ্ছন্ন। মোবাইলের লাইট জ্বলিয়ে দিতে হয় চিকিৎসা সেবা।
অপরিচ্ছন্নতা, ওয়ার্ডে পানি ও বিদ্যুতের সমস্যা, ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত বাথরুমসহ নানা সমস্যা রয়েছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিসংখ্যান কর্মকর্তা মো: মনিরুল ইসলাম জানান, ১৯৬৮ সালে নির্মিত হয় গাংনী উপজেলা ৩১ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন, একটি পৌরসভাসহ অন্তত সাড়ে চার লাখ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র সরকারি হাসপাতাল এটি। ২০০৮ সালে ৩১ শয্যার হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও সেবার মান আজও বাড়েনি। দেয়া হয়নি চাহিদা মতো জনবল ও চিকিৎসক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হাসপাতালে মোট ১০টি জুনিয়র কনসালটেন্ট চিকিৎসকের পদ থাকলেও খাতা-কলমে রয়েছেন ৪ জন। আর হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন ৩ জন। বাকি ১ জন অন্যত্র ডিউটিতে থাকেন। একজন এনস্থেসিয়া থাকলেও হাসপাতালে তার দেখা পাওয়া ভার। সার্জিক্যাল কনসালটেন্ট না থাকায় বন্ধ অপারেশন।
গাইনী, চক্ষু, অর্থপেডিক্স, কার্ডিওলজি, ইএনটি (নাক কান গলা) এবং চর্ম যৌন রোগের জন্য অতিব গুরুত্বপূর্ণ কনসালটেন্ট চিকিৎসকের পদ থাকলেও পদগুলি দীর্ঘদিন শুন্য থাকায় গাংনীবাসী কাঙখিত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
২০২৩ সালের জানুয়ারীতে ইলেক্টি্রশয়ানের(জুনয়র মেকানিক) পদটি মৃত্যু জনিত কারনে শূন্য হলেও আজও ইলেক্ট্রিশিয়ান দেয়া হয়নি ফলে হাসপাতালে বৈদ্যতিক ত্রুটি হলেই ফ্যান লাইটসহ সব যন্ত্রপাতি বন্ধ হয়ে যায়। হাসপাতাল হয়ে পড়ে ভুতুড়ে অবস্থা। ৩টি অফিস সহকারির পদ থাকলেও সবই শুন্য। ওয়ার্ড বয় পদ ৩টি এ পদই ২০২২ সাল থেকে রয়েছে শুন্য। ২০২১ সাল থেকে ২জন নৈশ্য প্রহরীর পদ থাকলেও দুটি পদই শুন্য। ৫জন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পদ থাকলেও মাত্র ১জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী রয়েছেন। তিনিও ঠিকমতো হাসপাতালটিতে আসেননা বলে অভিযোগ রোগী সাধারনের। মশালচি(কুক) পদে দুটি পদ থাকলেও আছে ১জন। ফলে ভর্তি রোগীদের খাবার সরবরাহ একার জন্য খুবই মুশকিল হয়ে পড়ে। রোগীদের সময়মত খাবার সরবরাহ করতে পারেনা।
হাসপাতালে প্রতিদিন তিন থেকে চার শতাধিক রোগী চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন। ভর্তি হন ৩৫-৪০ জন। চিকিৎসা দিতে না পারায় বেশিরভাগ রোগীকে উন্নত চিকিৎসার কথা বলে জেলা হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়।
গত বছর ২০২৩ সালের জানুয়ারী থেকে ৩০ ডিসেম্বও প্রর্যন্ত এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ লক্ষ ৭ হাজার ২৪৩জন। চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫০ হাজার ২৯৪ জন রোগী।
হাসপাতালের একমাত্র এক্স-রে মেশিনটি মাঝে মধ্যে ঠিক হলেও ফিল্ম থাকে না। দুটি অপারেশন থিয়েটার থাকলেও চিকিৎসকের অভাবে অব্যবহৃত পড়ে থাকে বছরের পর বছর। প্যাথলজি বিভাগ থাকার পরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগীদের বাইরের ক্লিনিকে পাঠানো হয়।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা উপজেলার লক্ষী নারায়নপুর ধলা গ্রামের বিলকিস খাতুন জানান, জরুরী বিভাগ থেকে ডাক্তার রোগের কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাইরে থেকে করিয়ে আনতে বলেন। আমরা গরীব মানুষ। টাকা দিয়ে বাইরে থেকে টেস্ট করানোর অবস্থা নেই। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ও ডাক্তার থাকলে আমাদের খুবই উপকার হতো। তিনি আরও জানান,১২টা বাজলে আর কোন পরিক্ষা করানো হয়না হাসপাতালে। তখন রোগীরা নিরুপাই হয়ে প্রাইভেট ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পরিক্ষা করাতে হচ্ছে।
অসুস্থ মাকে নিয়ে হাসপাতালে আসা কাথুলী গ্রামের আরজিয়া খাতুন বলেন, সকাল ৮টার দিকে হাসপাতালে এসেছি। সাড়ে ১১টা বাজলো। রোগীদেও অনেক ভীড়, এখনও আমার রোগী দেখলো না। সেবা নিতে এসে আমরা সেবা পাচ্ছি না।
উপজেলার আমতৈল গ্রামের আব্দুর রহমান বলেন, পেটের সমস্যা নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাই। কিন্তু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় মেডিকেল অফিসার ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন। কিন্তু ওষুধ খেয়ে অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।
বাঁশবাড়িয়া গ্রামের সাইদুল ইসলাম জানান, তিনি পায়ের ক্ষত নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে যান। সার্জারি বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় তাকে ১২ কিলোমিটার দুরে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে যেতে হয়েছে।
এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার সুপ্রভা রানী বলেন, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল বাড়ানো হয়নি। ১১জন চিকিৎসক দিয়ে চলছে চিকিৎসা সেবা। প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রোগীদের ভীড় থাকে। এসকল রোগীদেও চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসকরা হিমশিম খেয়ে যায়। হাসপাতালে চিকিৎসক, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবল সংকট রয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে শূন্য পদে জনবল ও চিকিৎসক পূরণ হলে চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব।