মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের হস্তচালিত টিউবওয়েলে পানি উঠছেনা। ফলে, এলাকার মানুষের মধ্যে পানির সংকট এখন চরমে পৌছেছে।
দীর্ঘ অনাবৃষ্টি, ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার, অপরিকল্পিতভাবে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি তোলা, এবং পুকুর-খাল-বিল ভরাটের কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আগামিতে বৃষ্টিপাত না হলে পরিস্থিতি আরও অবনতি হবে বলেও জানান তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সীমান্তবর্তী মেহেরপুর জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। জেলার গাংনী উপজেলার ষোলটাকা ইউনিয়নের আমতৈল, মানিকদিয়া, কেশবনগর, শিমুলতলা, রইয়েরকান্দি, সহড়াবাড়িয়া, কাথুলি ইউনিয়নের গাঁড়াবাড়িয়া, ধলাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় চলতি শুষ্ক মৌসুম শুরু থেকেই সুপেয় পানির সংকট প্রকট হচ্ছে। এসব এলাকায় নিচের দিকে নামছে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর।
আরো পড়ুন: মেহেরপুরে তাপমাত্রার পারদ উঠল ৪০.৭ ডিগ্রিতে
জানা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সাধারণত মাটির নিচে ৫০-৬০ ফুট গভীরে পানির স্তর স্বাভাবিক থাকে। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় ওইসব এলাকায় পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলোও ক্রমেই শূন্য হয়ে পড়ছে। এতে একদিকে গৃহস্থালির কাজে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে বোরো চাষে পানির সংকটের আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, গ্রীষ্মকাল শুরু না হতেই এবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। অথচ, গ্রামে সুপেয় পানির জন্য নলকূপই শেষ ভরসা।
তারা বলেন, বাড়ির টিউবওয়েলে পানি মিলছেনা। দুই সপ্তাহ ধরে তাদের মোটর পানি তুলতে সক্ষম হচ্ছে না। পানি নিয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বলে জানান মানিকদিয়া গ্রামের গৃহবধূ শাহানারা। একই অবস্থা তাদের আশপাশেও। অথচ তাদের বাড়ি থেকে দেড়শ গজ দূরে বয়ে চলেছে মাথাভাঙ্গা নদী। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ভুগছেন তারা।
ভুক্তভোগীদের মতে, আগে ২০-৩০ মিনিট মোটর চালালেই বাড়ির ছাদের ট্যাংক পূর্ণ হয়ে যেতো। ১৫-২০ দিন ধরে-দুই- তিন ঘণ্টা মোটর চালালেও প্রয়োজনীয় পানি মিলছে না। এভাবে চলতে গিয়ে নষ্ট হচ্ছে অনেকের বৈদ্যুতিক মোটর।
মানিকদিয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমার বাড়ির টিউবওয়েলে প্রায় ১৫/২০ দিন পানি নেই। শুধু আমার বাড়ি নয়, মানিকদিয়া গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই একই অবস্থা। খাবার পানির জন্য এখানে হাহাকার শুরু হয়ে গেছে।
নাসির উদ্দিন জানান, প্রায় ১৫/২০ দিন আগ থেকে পানি পাচ্ছি না। সকাল ৯ টা পর্যন্ত সামান্য পানি পাইলেও দুপুরের পর থেকে বিকাল পর্যন্ত একেবারে পানি পাচ্ছিনে।
সরেজমিনে মানিকদিয়া গ্রামে দেখা গেছে এলাকার দশ/পনের গৃহবধূ ও শিশুরা জাগ, কলশি ও ঘড়া নিয়ে লাইন ধরে একটি টিউবওয়েল থেকে পানি সংগ্রহ করছেন।
গৃহবধু জোছনা খাতুন, শাহানাজ খাতুন রোকেয়া জানান, আমাদের টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। তাই এই টিউবওয়েল থেকে পানি নিতে এসেছি।
যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ হোসেন, বয়োবৃদ্ধ আসাদুল হক বলেন, পানির জন্য এমন কষ্ট জীবনেও পাইনি।
স্থানীয় কমিউনিটি ক্লিনিকের সিপিসিএইচ শাহিনা আক্তার জানান, আমার এখানে টিউবওয়েলের পানি না পাওয়ার কারনে স্থানীয় কমিউনিটর সদস্যদের মাধ্যমে ক্লিনিকে একটি বৈদ্যতিক মোটর বসানো হয়েছে।
ওই গ্রামের কৃষক আতিয়ার রহমান জানান, সকালের দিকে টিউবওয়েল অনেক চাপার পর সামান্য পানি উঠছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে সেটিও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এলাকার মানুষের মাঝে এখন পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়ে যাচ্ছে।
মানিকদিয়া গ্রামের কৃষক সেলিম উদ্দিন বলেন, শুধু হস্তচালিত টিউবওয়েলই নয়, স্যালো মেসিনও (গভীর নলকুপ) পানি কম উঠছে। মাঠে আগে যেখানে এক বিঘা জমি ভেজাতে ২ ঘন্টা লাগতো, এখন সেই জমি ভেজাতে ৬ ঘন্টা লাগছে। পাশে মাথাভাঙ্গা নদী আছে। নদীতেও পানি শুকিয়ে গেছি। নদীর ভিতর দিয়ে এখন মোটরসাইকেল চলছে। আমি ১৭/১৮ বছর আগে একবার এমনটি দেখিছিলাম।
কৃষক মহিদুল হক জানান, গরম পড়ার পর থেকে এলাকার টিউবওয়েলগুলোতে পানি কিছুই উঠছেনা। আমার নিজের টিউবওয়েলে পানি না উঠায় পাশের বাড়ির একটি টিউবওয়েল থেকে পানি সংগ্রহ করছি। প্রায় ১৫/২০ দিন এভাবে চলছে।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ হোসেন বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকের টিউবওয়েলসহ মানিকদিয়া গ্রামের ইখলাছ, ইলিয়াস কাঞ্চন, মশিউর রহমান, হাফিজুর, আইতাল হক, আইনাল হক, ইসমাইল হোসেন, নাজির হোসেন, বাবু, আজিত হোসেন, আসাদুল বিশ্বাসের বাড়িতে প্রথম পানি ওঠা বন্ধ হয়েছে।
ষোলটাকা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার পাশা বলেন, ষোলটাকা ইউনিয়নে মোট ৬২১৫ টি খানা রয়েছে।
এসব খানাগুলোতে প্রায় ৬ হাজার টিউবওয়েল রয়েছে। এই ইউনিয়নের ৪/৫ গ্রামে বিশেষ করে চৈত্র, বৈশাখ ও জৈষ্ঠ এই তিন মাস টিউবওয়েলে পানি থাকেনা। এই সমস্যাটা প্রায় ৩/৪ বছর আমি দেখছি। আমি জনপ্রতিনিধি হিসেবে জেলা প্রশাসক ও গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাহেবদের অনুরোধ জানাচ্ছি বিষয়টি নজরে নেওয়ার জন্য। ইউনিয়নে যে পরিমান বাজেট রয়েছে তা দিয়ে পানির এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়।
শিক্ষাবিদ ও পরিবেশবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘অপরিকল্পিত নগরায়নে খোলা জায়গা ও জলাধার কমে যাওয়ায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে পানির এ সংকট দেখা দিয়েছে, যা আমাদের জন্য অশনিসংকেত। এখনই সচেতন না হলে আগামীতে সমস্যা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে।’
দীর্ঘ অনাবৃষ্টি, বাড়তি তাপমাত্রা ও সেচ দেওয়ার জন্য ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন এ ভোগান্তির কারণ বলে মনে করছেন গাংনী উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান কল্লোল। ভূ-পৃষ্ঠীয় পানি বা সারফেস ওয়াটারের ব্যবস্থা করা সম্ভব না হলে আগামীতে এ সংকট আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা এই কর্মকর্তার।
গাংনী উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে, গাংনী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সুপেয় পানির স্তর প্রতিবছর ১০ থেকে ১১ ফুট নিচে নামছে। ১০ বছর আগেও এই এলাকায় ৬০ থেকে ৭০ ফুটের মধ্যে ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর পাওয়া যেতো। অথচ এখন পানির জন্য যেতে হয় ৩০০ ফুটেরও বেশি গভীরে।
তিনি আরও বলেন, গত কয়েক বছরে এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর ১০ থেকে ১৫ ফুট নিচে নেমেছে। ফলে অকেজো হয়ে পড়েছে হস্তচালিত অনেক টিউবওয়েল। ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন তিনি।