আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে ৩ দিন ব্যাপী শুরু হচ্ছে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ-এর ১৩৪তম তিরোধান স্মরণে তিন দিনের স্মরণোৎসব।
কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার ছেঁউড়িয়ায় বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ এর তিরোধান দিবস উপলক্ষে ইতোমধ্যেই সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় লালন একাডেমির আয়োজনে এই আয়োজনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে।
তিন দিনের এই স্মরণোৎসবকে ঘিরে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ছেউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে মাজার প্রাঙ্গণ। কালী নদীর পাড়ের বিশাল মাঠ জুড়ে চলছে মূল মঞ্চসহ গ্রামীণ মেলার স্টল তৈরির কাজও শেষ হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে থেকেই হাজারো ভক্ত-অনুসারীরা দূর দূরান্ত থেকে আসতে শুরু করেছেন। লালন মেলা উপলক্ষ্যে আখড়াবাড়িতে হাজারো ভক্ত-অনুসারীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। একাডেমির নিচে এবং আশেপাশের এলাকাসহ লালন আঁখড়াবাড়িতে সমবেত হচ্ছেন সাধু ভক্ত-অনুসারীরা।
একদিকে, বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সাধু-গুরুরা তাদের শিষ্যের সঙ্গে ভাব বিনিময়ে মত্ত থাকছেন। অন্যদিকে, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে একতারা আর ঢোল বাজিয়ে সাঁইজীর মরমী সংগিত পরিবেশন করছেন। দিনরাত গান ছাড়াও তারা লালন ফকিরের বাণী নিয়ে একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করছেন। অনেকে আবার লালনের মত ও পথের দীক্ষা নিচ্ছেন। আর এ মেলা দেখতে আসছেন হাজারো মানুষ।
এক কথায় উৎসব শুরুর আগেই নদীর পাড়ঘেঁষে গুরুশিষ্য, ভক্ত-অনুসারী আর দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়েছে প্রাঙ্গণ।
লালন ভক্ত ও অনুসারীরা জানান, প্রতিবারই লালন মেলায় লাখ লাখ মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়। এবার মেলা শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকেই দূরদূরান্ত থেকে হাজারো ভক্তরা এসেছেন। যতই সময় পার হচ্ছে ততই ভিড় বাড়ছে।
লালন মেলায় আসা আসিফ ইকবাল নামের এক দর্শনার্থী বলেন, লালন মেলা উপলক্ষে আখড়াবাড়িতে দূর দূরান্ত থেকে ভক্ত অনুসারীরা এসেছেন। এখানে এসে খুবই ভালো লাগছে। লালন ভক্ত ও অনুসারীদের আস্তানাগুলো দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। তাদের গাওয়া গান শুনতে ভালো লাগে। জায়গায় জায়গায় তারা গান গাচ্ছেন। লালন সাঁইজির গানে ও বাণীতে এই এলাকা মুখরিত হয়ে উঠেছে।
চুয়াডাঙ্গা থেকে আসা লালন ভক্ত শান্ত ফকির বলেন, লালন স্মরণ উৎসব হল দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজারো ভক্ত অনুসারীদের মিলন মেলা। বছরের দুটো অনুষ্ঠানের জন্য আমরা অপেক্ষায় থাকি। এখানে আমরা ছুটে আসি আবার আত্মশুদ্ধির মধ্য দিয়ে তৃপ্তি নিয়ে যে যার গন্তব্যে ফিরে যায়।
লালন একাডেমির কয়েকজন সদস্য ও স্থানীয়রা বলেন, লালন ফকির দীর্ঘ সময় ধরে তার নিজস্ব আত্মদর্শনের আলোকে ভক্ত আশেকান ও শিষ্যদের নিয়ে যেসব উৎসবমুখর কর্মকাণ্ড করতেন, তারই ধারাবাহিকতায় পহেলা কার্তিক সাঁইজির তিরোধান দিবস পালন করতে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভক্তশিষ্য-অনুসারীরা ছেঁউড়িয়ার আঁখড়াবাড়িতে মিলিত হন।
শিল্পী সাব্বির কোরাইশি বলেন, ফকির লালনের অজানা কথা ও তথ্য জানার পাশাপাশি মানুষের মিলন-মেলায় মুখর হয়ে উঠবে। লালনের বাণীর মর্ম দেশ-দেশান্তরে পৌঁছে দিতেই তাঁরা প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
এবারের লালন স্মরণোৎসবকে ঘিরে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। এর পাশাপাশি অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরাও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন। তিনদিনের এই আয়োজন নির্বিঘ্নে শেষ করতে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
কুষ্টিয়ার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমির এডহক কমিটির সভাপতি শারমিন আখতার বলেন, বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের ১৩৪তম তিরোধান দিবস উপলক্ষ্যে তিনদিন ব্যাপী লালন মেলার আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিদিনই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে আলোচনা সভা শুরু হবে, আলোচনা শেষে শুরু হবে লালন সঙ্গীত। মেলার সার্বিক প্রস্তুতি চলছে। মাজার প্রাঙ্গণ ও তার আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করবে।
উল্লেখ্য, মরমী সাধক ফকির লালন শাহ কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ছেঁউড়িয়া গ্রামে ১৮৯০ সালের ১ কার্তিক মারা যান। পরবর্তী সময়ে লালন স্মরণোৎসবের আয়োজন করা হয়। সেই থেকে প্রতি বছরই নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাদের কাঙ্খিত এ উৎসব পালন করা হয়। সাঁইজির স্মরণে দিবসটি ঘিরে তিন দিনের অনুষ্ঠান হয় আখড়াবাড়িতে।