১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মেহেরপুর সদর উপজেলার যাদুখালী স্কুল এন্ড কলেজ। স্কুলের পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ভৈরব নদ। নদের এপাড় -ওপাড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২টি গ্রামের এগারশ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে এই প্রতিষ্ঠানে। নদীর ওপাড় থেকে আসে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী। কিন্তু ৭৫ বছর পেরিয়ে গেলেও নদীর উপর দিয়ে এখনও নির্মাণ হয়নি ব্রীজ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাঁশের সাঁকো ও ফরাস দিয়ে নদ পারাপার হতে হয় শিক্ষার্থীদের। কিছুদিন হলো স্থানীয় চেয়ারম্যান একটি ছোট নৌকা দিয়েছেন। যে নৌকায় একবারে ১০ জনের বেশি পার হওয়া ঝুঁকি।
শিক্ষার্থীদের পারাপারের জন্য স্কুল থেকে অস্থায়ী ভিত্তিতে একজন মাঝি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি স্কুলের দিনগুলো সকাল ৯টা থেকে স্কুল ছুটি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পারাপার করেন।
সম্প্রতি দুপুর দেড়টার দিকে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, স্কুল ছুটি শেষে ৬-৭ জন শিক্ষার্থী নদের ওপাড়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য নৌকায় উঠছেন। স্কুলের একজন স্টাফ (মাঝি) তাদের বৈঠা বেয়ে তাদের নদ পার করে ওপাড়ে রেখে আসছেন। এর মধ্যে কলেজের ক্লাস শেষ করে দুই জন ছাত্রীও ওপাড়ে যাওয়া জন্য নদতীরে এসেছেন। ততক্ষণে নৌকা ওপাড়ে পৌছে গেছে। নৌকা ফেরার অপক্ষোয় তারা এপাড়ে দাড়িয়ে থাকলেন। এভাবেই প্রতিদিন জীবনের ঝুকি ও সময় নষ্ট করে প্রতিদিন স্কুলে আসতে হচ্চে ওপাড়ের তিন শতাধিক শিক্ষার্থীকে।
যাদুখালী স্কুল এন্ড কলেজের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মোবারক হোসেন রিয়াদ বলেন, আমাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে আসতে হচ্ছে। কিছুদিন আগে নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় অনেকদিন স্কুলে আসতে পারিনি।
কোমরপুর গ্রামের রহিমা খাতুন নদীর এপাড়ে এসেছিলেন আত্মিয়ের বাসায় বেড়াতে। স্কুল সময়ের মধ্যে নৌকা পার হতে হবে জেনে ওই সময় বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, সাঁকো ভেঙে যাওয়ার কারণে এদিকে আসা যাওয়ার খুব সমস্যা হয়। স্কুলের ছেলে মেয়েদেরও আসা যাওয়া সমস্যা হয়। আমাদেরও ছেলে মেয়ে বড় হচ্ছে। তাদেরকেও এই স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। এ নদীর উপর ব্রীজটা হলে খুব ভালো হয়।
গোপালপুর গ্রামের সোহরাভ হোসেন বিভিন্ন ক্ষেত থেকে সবজি কিনে নদীর ওপারে যতারপুরে মোকামে বিক্রি করেন। প্রতিদিন স্কুল চলাকালীন সময়ে নৌকা পার হন। কিন্তু সেদিন দেরি হয়ে যাওয়ায় নৌকা পাননি। এখন তাকে কয়েকটি গ্রাম অতিক্রম করে মোকামে যেতে হবে। তিনি দাবী করে বলেন, ব্রীজটা নির্মান না হওয়ায় দুই পাড়ের মানুষের ভোগান্তী পোহাতে হচ্ছে।
স্কুলের স্টাফ মোমিন উদ্দিন। তিনি জানান, তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত মাঝি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিদিন প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থীকে তিনি নৌকায় করে নদী পার করান। এর মধ্যে গ্রামের মানুষ জনকেও পার করিয়ে থাকেন।
যাদুখালী স্কুল এন্ড কলেজে একাদশ শেণ্রীর ছাত্রী তাসলিমা আক্তার ও আফসানা মিমি। কলেজের ক্লাস শেষ করে দুপুর দেড়টার দিকে বাড়ি ফিরছিলেন। এরা কেউ সাঁতার জানেন। তাসলিমা আক্তার বলেন, নদের ওপাড় থেকে প্রায় দুই শতাধিক ছেলে মেয়ে এই স্কুলে পড়ে। আমরা দুজনই ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে এই স্কুলে পড়েছি। এসএসসি পাশ করার পর আবার এখানেই ভর্তি হয়েছি। আমাদের মত অনেকেই সাতার জানেনা। আমরা প্রতিনিয়িত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদীর পার হয়ে কলেজে আসতে হচ্ছে। সরকারের প্রতি অনুরোধ দ্রুত ব্রীজটি নির্মাণ করে আমাদের সমস্যা সমাধান করুন।
পিরোজপুর গ্রামের ৭০ বছর বয়সি আব্দুল কুদ্দুস। তিনি বলেন, ব্রীজটা হলে আমাদের খুব ভালো হয়। বহু বছর ধরে শুনছি এখানে ব্রীজ হবে। কিন্তিু ব্রীজটি আজও হয়নি। নদীর দুধারে প্রায় ১২/১৩ টি গ্রামের মানুষের খুবই উপকার হয়। স্কুলের অনেক ছেলে মেয়ে নদীর ওপাড় থেকে আসে। তবে চেষ্টা করলে সবই হয়। কিন্তু চেষ্টা ভালো নেই বলেই ব্রীজটি হয়নি।
যাদুখালী স্কুল এন্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক মনোয়ার হোসেন বলেন, এই প্রতিষ্ঠানটি জেলার ঐতিহ্যবাহী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখান শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মানও ভালো। নদীতে ব্রীজ না হওয়ার কারণে ওপাড়ের শিক্ষার্থীরা যেমন অসুবিধার সম্মুখিন হয়। একইভাবে নদটি এপাড়-ওপাড়ের শিক্ষার্থীদের নোট আদান প্রদান, মতবিনিময়েও ব্যঘাত ঘটে। ফলে ব্রীজটি অনেক আগেও নির্মাণের প্রয়োজন ছিলো। তারপরও দাবী করছি যেন দ্রুত ব্রীজটি নির্মাণ করা হয়।
যাদুুখালী স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাইদ কামাল বলেন, প্রতিষ্ঠানের পশ্চিম পাশ দিয়ে ভৈরব নদ বয়ে গেছে। নদীর ওপারে যতারপুর, কোমরপুর, মহাজনপুর, সাহেবনগর, ইসলামপুর থেকে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ে লেখপড়া করার জন্য নদী পার হয়ে আসে। অনেকটা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানে আসে। এর আগে সাকো ও ফরাস নির্মান করে ছেলে মেয়েদের আসা যাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। বর্তমান পিরোজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান একটি ছোট নৌকা উপহার দিয়েছেন। যা দিয়ে বর্তমানে ছেলে মেয়েরা ঝুকি নিয়ে পারাপার করছে।
তিনি বলেন, ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা হলেও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে ব্রীজটা নির্মাণ হয়নি। কয়েকবার ব্রীজ নির্মাণের জন্য জমি পরিমাপ করা হয়েছে। তারপরও ব্রীজ নির্মাণের কোন অগ্রগতি দেখা যায়নি। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ও ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ বাবলু বিশ^াসকে নতুন করে তাগাদা দেওয়ার ফলে তারা উদ্যোগ নিয়েছেন যাতে দ্রুত ব্রীজ নির্মাণ করা হয়।
মেহেরপুর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী সাখাওয়াৎ হোসেন বলেন, যাদুখালী গ্রামে ভৈরব নদে ব্রীজ নির্মাণের জন্য ডিপিপিতে প্রকল্প ধরা আছে। উর্দ্ধতন মহল থেকে অনুমতি না মেলায় টেণ্ডার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।