২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি জাহাজ নিয়ে চায়না থেকে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের একটি সমুদ্র বন্দর লং বিচ এ যাই। সে সময় আমার লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের বিখ্যাত হলিউড সাইন ছাড়াও আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ঘোরার সুযোগ হয়েছিল। হলিউড হিলস এ আরেকটি দর্শনীয় স্থান হল গ্রিফিথ অবজারভেটরি বা গ্রিফিথ মানমন্দির। এখানেও প্রচুর দর্শনার্থী দেখা যায়। গ্রিফিথ মানমন্দিরটি পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। এটি সমতল ভূমি থেকে প্রায় ১১০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত।
আমরাও কয়েকজন মেরিনার অন্যান্য দর্শনার্থীদের মতোই এই গ্রিফিথ মানমন্দিরে প্রবেশ করি ভিতরে কি আছে দেখার জন্য। ভেতরে যাবার আগে আমাদের এই মানমন্দিরটি সম্পর্কে তেমন একটা ধারণা ছিল না। আমাদের হাতে সময় কম থাকায় অল্প সময়েই আমরা ঘুরে দেখার চেষ্টা করি।
গ্রিফিথ মানমন্দিরটি ১৯৩৫ সালে স্থাপিত হয়। ক্যালিফোর্নিয়াতে গ্রিফিথ মানমন্দিরটি দেশটির জাতীয় জ্যোতির্বিদ্যার অন্যতম প্রদর্শনীয় স্থান। স্থানটি সকল জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত এবং কোনো টিকেটের প্রয়োজন হয় না। এর ভিতর রয়েছে প্রাচীন এবং আধুনিক টেলিস্কোপ ও গবেষণার জন্য নিয়োজিত বিভিন্ন উপাদান যেগুলো আকাশ ও বিভিন্ন গ্রহ,উপগ্রহ দেখার কাজে ব্যবহৃত হয় এটি জনসাধারণকে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে, চিন্তা করতে এবং আকাশ দেখতে উৎসাহিত করে।
গ্রিফিথ অবজারভেটরির শিখরে একাধিক অত্যাধুনিক টেলিস্কোপ রয়েছে যেগুলো জনগণের জন্য উন্মুক্ত।এই টেলিস্কোপের সাহায্যে মেঘমুক্ত আকাশে সৌরজগতের গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র এবং সূর্যের দাগ, সূর্যের অগ্নিশিখা দেখা যায়। সৌরশিখা হলো সূর্যের বায়ুমন্ডলে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বিকিরনের একটি তীব্র বিস্ফোরণ। সূর্যের সক্রিয় অঞ্চলে প্রায়ই এই তীব্র বিস্ফোরণ হয়। এর সাথে করনাল ভর নির্গমন, সৌর কণা ঘটনা এবং অন্যান্য সৌর ঘটনাও সংঘটিত হয়।
গ্রিফিথ অবজারভেটরির মধ্যে রয়েছে প্রাচীন এবং আধুনিক টেলিস্কোপ, সুইং পেন্ডুলাম, টেসলা কয়েল,গ্রহ নক্ষত্র দেখার জন্য অত্যাধুনিক প্রজেক্টর ইত্যাদি। এছাড়াও এখানে রয়েছে সামুয়েল ওসসিন প্লানেটেরিয়াম থিয়েটার যা বিশ্বের সেরা প্ল্যানেটেরিয়াম। এখানে লাইভ শোতে বিভিন্ন গ্রহ, উপগ্রহ এবং মহাবিশ্বকে দেখানো হয়। এই লাইভ শো দেখার জন্য অবশ্য আলাদাভাবে টিকিটের প্রয়োজন হয়। গ্রিফিথ অবজারভেটরি হলো দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার মহাজাগতিক প্রবেশদ্বার। দর্শকরা টেলিস্কোপের মাধ্যমে দেখতে পারেন, প্রদর্শন গুলো অন্বেষণ করতে পারেন। সেই সাথে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারেন।
১৯৩৫ সালে এটি খোলার পর থেকে ৭ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ আসল ১২ ইঞ্চি জিস টেলিস্কোপ ব্যবহার করে আকাশ দেখেছে। বিশ্বের অন্য যেকোনো টেলিস্কোপের চেয়ে বেশি মানুষ এটি ব্যবহার করেছে।
টেলিস্কোপ বা দূরবীক্ষণ যন্ত্র হলো এমন একটি যন্ত্র যা দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তু দর্শনের জন্য ব্যবহার করা হয়। এটি দূরবর্তী বস্তু থেকে নির্গত বিকিরণ সংগ্রহ, পরিমাপ এবং বিশ্লেষণ করার কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্রটি তৈরি করেছিলেন হ্যানস লিপারশে ১৬০৮ সালে। পরবর্তীতে ১৬০৯ সালে দূরবর্তী তারা পর্যবেক্ষণের জন্য গ্যালিলিও গ্যালিলি একটি দুরবীক্ষণ যন্ত্র তৈরি করেন। গ্যালিলিও তার দুরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে বৃহস্পতির উপগ্রহ এবং শনির বলয় পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। সেজন্যই প্রথম দিকের টেলিস্কোপ এর মধ্যে গ্যালিলিও টেলিস্কোপ বিখ্যাত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বৈমানিক এবং অ্যাপোলো মহাকাশচারীরা গ্রিফিথ অবজারভেটরির প্লানেটেরিয়াম থিয়েটারে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন কিভাবে আকাশের স্টার বা তারা দ্বারা নেভিগেট করতে হয়।
গ্রিফিত মানমন্দিরের সামনেই রয়েছে সর্বকালের সেরা ৬ জন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর স্মৃতিস্তম্ভ। বিজ্ঞানী হিপারকাস,নিকোলাস কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও গ্যালিলেই, জোহানেস কেপলার,আইজ্যাক নিউটন,উইলিয়াম হারসেল সকলেই জ্যোতির্বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এজন্যই তারা আজ চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
গ্রিফিথ অবজারভেটরিতে উল্লেখযোগ্য টেলিস্কোপ গুলোর মধ্যে রয়েছে জিস টেলিস্কোপ, সোলার টেলিস্কোপ, গ্যালিলিও টেলিস্কোপ। এছাড়াও এখানে প্রাচীন টেলিস্কোপ সংরক্ষিত রয়েছে। আমারও সুযোগ হয়েছিল কয়েকটি টেলিস্কোপের উপর চোখ রাখার।
বর্তমানে গ্রিফিথ মানমন্দির পৃথিবীর অন্যতম জ্যোতির্বিদ্যার কেন্দ্রবিন্দু যা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। প্রতিষ্ঠাতা জে গ্রিফিথ চেয়েছিলেন জনসাধারণ যেন টেলিস্কোপ দিয়ে এই মহাজগৎ কে দেখতে পারে যা দেখে হয়তো মানুষের মন আরো প্রশস্ত হবে।
গ্রিফিথ অবজারভেটরি হল এই অঞ্চলের অন্যতম ফিল্ম লোকেশন। এটি অনেক ফিল্ম এবং টেলিভিশন প্রোডাকশনে উপস্থাপিত হয়েছে। কর্নেল গ্রিফিথ লস অ্যাঞ্জেলেসে বসতি স্থাপন করেন পরে তিনি ১৮৯৬ সালে গ্রিফিথ পার্কের জন্য বিশাল এলাকা ক্রয় করে সিটি অফ লস অ্যাঞ্জেলেস কে দান করেন। তার নাম অনুসারে এলাকাটির নাম গ্রিফিথ পার্ক হয়েছে।
লেখক: মাস্টার মেরিনার, এক্স ক্যাডেট,বাংলাদেশ মেরিন একাডেমী চট্টগ্রাম।