দ্বাদশ জাতীয় সংসদে কারা বিরোধী দল? ১১টি আসন নিয়ে জাতীয় পার্টি (জাপা) নাকি ৬২টি আসনে জয়ী হয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিরোধী দল হবে? নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে বিরোধী দল নিয়ে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা জোট করে বিরোধীদলে বসতে পারবে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের মর্যাদা হারাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সংবিধান এবং জাতীয় সংসদের কার্যক্রম পরিচালিত হয় যে কার্যপ্রণালিবিধি দ্বারা, তার কোথাও বিরোধী দল সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট বিধান নেই। ৩০০ আসনের মধ্যে ন্যূনতম কতগুলো আসন পেলে কোনো দল বিরোধী দলের চেয়ারে বসতে পারবে কিংবা বিরোধীদলীয় নেতা কে হবেন, তার যোগ্যতা কী হবে সে বিষয়েও স্পষ্ট কিছু বলা নেই।
তবে অঘোষিতভাবে জাতীয় সংসদে একটি বিধান রয়েছে, সেটি হচ্ছে একটি রাজনৈতিক দলকে ১০ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ অন্তত ৩০টি আসন পেলে বিরোধী দলের মর্যাদা দেওয়া হয়। সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ২(১) (ট) ধারায় বলা হয়েছে, বিরোধীদলীয় নেতা অর্থ হল, “স্পিকারের বিবেচনামতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমতে দল বা অধিসঙ্গের নেতা।”
বিশেষ ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে একমত হতে পারলে তারা সংসদে বিরোধী দলে বসতেও পারেন। এজন্য তাদের একটি ‘মোর্চা’ বা ‘ককাস’ (রাজনৈতিক জোট) গঠন করে এক কাতারে আসতে হবে। এরশাদের আমলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সে সময় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (রব) উদ্যোগে ‘কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টিস (কপ)’ নামে সম্মিলিত বিরোধী দল গঠিত হয় এবং তারা নির্বাচনে অংশ নেয়। তারা তখন ১৯টি আসন পেয়েছিল। গ্রুপ হওয়ার কারণে তারা তখন সংসদ সদস্য হলেও বিরোধী দলের মর্যাদা পাননি। পরে অন্যান্য দলের আরও ১৪ জন সংসদ সদস্য আ স ম আবদুর রবকে নেতা মেনে স্পিকারের কাছে আবেদন করলে স্পিকার তাকে বিরোধী দলের নেতার স্বীকৃতি দেন।
সংসদীয় আইনেও বলা আছে, ‘বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সংসদের প্রতিনিধিত্বকারী যেকোনো দলের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন অথবা স্বতন্ত্র হিসেবেই থাকতে পারেন।’ নবম সংসদের পুরো সময়ে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হিসেবে ফজলুল আজিম আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অংশ নেন। অর্থাৎ স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হিসেবে থাকলেও অসুবিধা নেই।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘প্রচলিত রীতি হলো, নির্বাচনের পর যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাবে তারা সরকার গঠন করবে। এরপর যারা তাদের চেয়ে কম সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে তারা বিরোধী দলে থাকবে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরেই স্বতন্ত্ররা বেশি আসন পেয়েছেন। তাদের অনেকে নিশ্চয়ই সরকারের সঙ্গেও থাকতে চাইবেন। এখন কারা বিরোধী দলে থাকতে চান, সেটা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। যারা হতে চায় তাদের তো গ্রাউন্ড লাগবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী তানজীব উল আলম বলন, ‘বিরোধী দল বলতে কোনো দলকে বোঝায় না। সংখ্যাগরিষ্ঠরা সরকার গঠন করবে। পরের সংখ্যাগরিষ্ঠরা যদি প্রস্তাব করেন আমরা এতগুলো সংসদ সদস্য আছি এবং একত্রিত হয়েছি, আমাদের বিরোধী দলের মর্যাদা দেওয়া হোক। তখন স্পিকার যাচাই করে দেখবেন এবং বিরোধী দলের জন্য যতটুকু সংসদ সদস্য প্রয়োজন তা থাকলে তিনি মর্যাদা দেবেন। পরে স্পিকার সংসদের বিরোধী দলের নেতা, উপনেতা, চিফ হুইপ ও হুইপ কারা হবে তা জানাতে বলবেন। স্বতন্ত্র যে ৬২ জন নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের কেউ আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো দলে যোগ দিলে তা সংসদ সদস্য পদ খারিজ হবে না। ফলে তিনি বিরোধী দলে থাকতে পারেন বা অন্য দলেও যোগ দিতে পারে।’
স্বতন্ত্রদের জোট আগেও হয়েছে। বিএনপির বর্জনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জেতেন ১৬ জন। সেই সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন দলগুলোর মধ্যে আনুপাতিক হারে বণ্টনের সময় স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদেরকে চিঠি দেওয়া হয় তারা জোটবদ্ধ হবেন কি না। এরপর ১৬ জন জোটবদ্ধ হলে সংরক্ষিত নারী আসনের মধ্যে তিনটি বরাদ্দ দেওয়া হয় স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের। ২০১৭ সালের মে মাসে এদের মধ্যে ১৪ জন একসঙ্গে এবং এরপর আরও দুই জন আওয়ামী লীগে ফিরে যান।
বিরোধী দল ছাড়াও সংসদ ছিল। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় নির্বাচনের পর যে সংসদ গঠন হয়, তাতে বিরোধীদলীয় নেতার আসনে কেউ বসেননি। সেবার ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ একাই পায় ২৯৩টি। একটি করে আসন পায় জাসদ ও জাতীয় লীগ। বাকি পাঁচটি আসন পান স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা। তারা জাতীয় লীগ নেতা আতাউর রহমান খানকে তাদের নেতা নির্ধারণ করে বিরোধী দলের নেতার মর্যাদা দিতে স্পিকারের কাছে আবেদন জানান। তবে সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আপত্তি জানিয়ে বলেন, বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে একটি রাজনৈতিক দলের অবশ্যই কমপক্ষে ২৫টি আসন থাকতে হবে। না হলে তাদেরকে পার্লামেন্টারি গ্রুপ হিসেবে বলা যেতে পারে, কিন্তু বিরোধী দল নয়।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও বামপন্থি দলগুলোর বর্জনের মধ্য ভোটের পর গঠিত সংসদেও একই ঘটনা ঘটে। বিএনপিকে সেই নির্বাচনে ২৭৮টিতে জয়ী দেখানো হয়। ১০টি আসনে স্বতন্ত্র এবং একটিতে ফ্রিডম পার্টির নেতা বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার আব্দুর রশীদকে বিজয়ী দেখানো হয়। বাকি ১১টি আসনের মধ্যে ১০টিতে কাউকে বিজয়ী দেখানো হয়নি। একটিতে ভোট স্থগিত ছিল।