ভক্তরা কখনো প্রিয় তারকার প্রতিকৃতি বানান, কখনো প্রিয় তারকার বাড়ির সামনে ফ্রেমবন্দী হন। প্রিয় তারকাকে নিয়ে ভক্তদের ‘পাগলামি’র বহু নজির রয়েছে। তবে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন সালমান শাহর ভক্তরা।
ঢাকাই সিনেমার এই প্রয়াত তারকার সিনেমাগুলোকে নতুন সংস্করণে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন তাঁরা। সালমান শাহর ভক্তরা মিলে এর মধ্যেই প্রিয় তারকার ১১টি সিনেমাকে ডিজিটালে রূপান্তর করছেন। পর্যায়ক্রমে সালমানের সব কটি সিনেমাকেই ডিজিটালে রূপান্তর করতে চান তাঁরা।
অভিমান নিয়ে সোহান সেদিন বলেছিলেন, ‘তাদের বলে দিয়ো, আমি সালমান শাহ আর মৌসুমীকে কোনো টাকা দেই নাই’
২০১৯ সালের কথা। সেবার সালমান শাহর সিনেমা নিয়ে মধুমিতা সিনেমা হলে ‘সালমান শাহ উৎসব’ হয়। সেই উৎসবে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন ইভান মল্লিক।
কিন্তু বড় পর্দায় প্রিয় তারকার সিনেমা দেখে হতাশ হন। বুঝতে পারেন ইউটিউব থেকে প্রিন্ট ডাউনলোড করা চালানো হচ্ছে। সেই প্রিন্ট ঝাপসা। রেজল্যুশন খুবই কম, বড় বড় লোগো যুক্ত করা।
তাঁর মতো অবস্থা ছিল আরও অনেক সালমান–ভক্তেরই। পরের বছর টিএসসিতে সালমান শাহর ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ দেখতে গিয়েও একইভাবে হতাশ হতে হয় ভক্তদের।
গত বছরের অক্টোবরে ফিল্ম আর্কাইভের একটি আয়োজনে দেখানো হয় ‘তোমাকে চাই’ সিনেমাটি। সেই সিনেমার দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট। সেখানে ‘তোমাই চাই’, ‘তুমি আমায় করতে সুখী জীবনে’, ‘বাজারে যাচাই করে দেখিনি তো দাম’সহ সিনেমাটির জনপ্রিয় পাঁচটি গান ছিল না। সাউন্ড ঠিক ছিল না। সব মিলিয়ে সেটা কোনোভাবেই প্রদর্শনযোগ্য সংস্করণ ছিল না বলে মনে হয় ইভান মল্লিকের। সেদিনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন সিনেমাগুলো ডিজিটাল সংস্করণে রূপান্তরের উদ্যোগ নেবেন। তিনি মনে করেন, সালমান শাহর সিনেমা সংরক্ষণ না করলে অল্প কিছুদিনের মধ্যে মূল প্রিন্ট হারিয়ে যাবে।
ইভান নিজেও একজন সম্পাদক ও পরিচালক। তাঁর নিজস্ব প্যানেল রয়েছে। একবার নিজের তথ্যচিত্রের কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক জনাথন পার্লের সঙ্গে। যিনি নিজেও সম্পাদক। তাঁর কাছ থেকে ইভান পরামর্শ পান, কীভাবে সিনেমাগুলোকে অল্প রেজল্যুশন থেকে উচ্চতর রেজল্যুশনে উন্নীত করা যায়, কীভাবে ডিজিটাল সংস্করণে রূপান্তর করা যায়। ইভান বললেন এরপরের গল্প, ‘আমি নেমে পড়ি সালমান শাহর সব সিনেমার প্রিন্ট সংগ্রহ করতে। কিন্তু বারবার হতাশ হতে হয়। কেউ কেউ প্রিন্ট দিতে চায় না। একসময় একটি আইপি টিভিতে সম্পাদক হিসেবে কাজ করতাম। কাজ করার সময় জেনেছিলাম, সেখানে কিছু সিনেমার মূল প্রিন্ট ডিভিডিতে সংরক্ষিত আছে। খুঁজতে খুঁজতে ১১টি সিনেমা পেয়ে যাই।’ সিনেমাগুলো হলো ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘দেনমোহর’, ‘প্রেম যুদ্ধ’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘বিক্ষোভ’, ‘জীবন সংসার’, ‘মহামিলন’, ‘আশা ভালোবাসা’, ‘আনন্দ অশ্রু’ ও ‘অন্তরে অন্তরে’।
ইভান তাঁর সিনেমার কাজে প্রায়ই কলকাতায় যেতেন। একবার যাওয়ার সময় কলকাতায় সালমান শাহর সিনেমাগুলো নিয়ে যান। শুরু হয় সংগ্রাম। তিনি বলেন, ‘কলকাতায় গিয়ে আমরা সিনেমাগুলো রেজল্যুশন মাস্টারিং করি। শব্দে যোগ করি ডলবি সাউন্ড সিস্টেম, প্রিন্ট একদম ঝকঝকে হয়ে যায়। মনে হচ্ছিল, একদম নতুন সিনেমা।
এই প্রক্রিয়াকে টিসি সিংক বলা হয়। এআই প্রযুক্তির সাহায্যে হাই রেজল্যুশনে নতুন করে প্রিন্ট করি। কাজ শেষ করে আমার কাছে সালমান শাহর ভক্ত হিসেবে গর্ব হচ্ছিল। বারবার ভাবছিলাম, দেশের একজন জনপ্রিয় তারকার সিনেমাগুলো কী অবহেলায় ছিল। যেগুলো আর কয়েক বছর পরে হয়তো খুঁজেই পাওয়া যেত না।’
প্রাথমিকভাবে তিনি ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ ও ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’ সিনেমা দুটি ডিজিটালে রূপান্তর করেন। প্রিন্টগুলো ভালো লাগায় পরে একে একে ১১টি সিনেমা ডিজিটাল সংস্করণে রূপান্তর করেছেন। এই উদ্যোগে প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ইভান বলেন, ‘আমার পরিবার এগুলোকে পাগলামি মনে করে।
কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, এই প্রিন্ট সংরক্ষণ করা দরকার। নইলে পরবর্তী প্রজন্ম সালমান শাহর সিনেমাগুলো দেখতে পারবে না। আমরা সিনেমা দুটি নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করি। সেখানে ঝকঝকে প্রিন্ট দেখে দর্শকেরা করতালি দিয়েছেন, প্রশংসা করেছেন—এটাই আমার কাছে গর্ব ও সেরা প্রাপ্তি।’
সালমান শাহর সব সিনেমার কাজ শেষ করতে অনেক টাকা প্রয়োজন। এদিকে সরাসরি ভক্তদের সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয়গুলো ভাগাভাগি করতে চাননি ইভান।
তিনি মনে করেন, এটা করতে গেলে অনেকেই বিষয়টি ভিন্নভাবে নিতে পারেন। তখন তিনি দুটি সিনেমা নিজ খরচে ফিল্ম আর্কাইভ ভাড়া নিয়ে প্রদর্শনীর উদ্যোগ নেন। সেখানে আড়াই শর মতো সালমান–ভক্ত সিনেমা দুটি দেখতে আসেন। সাজিদ কামাল নামের এক ভক্ত বলেন, ‘সিনেমা দেখে মনেই হয়নি এটা ২৭ বছর আগের ছবি। মনে হচ্ছিল এই সময়ের ছবি। যেন নতুন সালমান শাহকে দেখলাম। ইভান ভাইকে সাধুবাদ সিনেমাগুলো ডিজিটাল করার জন্য। তাঁকে সামনে রেখে আমরা সবাই মিলে বাকি সিনেমাগুলোর ডিজিটাল প্রিন্ট সংরক্ষণ করতে চাই।’
প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন জীবন সংসার সিনেমার পরিচালক জাকির হোসেন রাজু। তিনি বলেন, ‘সিনেমার প্রিন্ট দারুণ ছিল। দর্শক মূল প্রিন্টের চেয়ে বেশি পছন্দ করবে।
সালমান শাহর সিনেমা নিয়ে এই উদ্যোগ আনন্দের বিষয়।’ সবশেষে ইভান জানান, সিনেমাগুলো তাঁরা সংরক্ষণ করে প্রদর্শনী করতে পারবেন। তবে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করতে পারবেন না। এতেই তাঁরা খুশি।
সূত্র: প্রথম আলো