তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ট্রেন। তবে সেই ট্রেনে কারা কারা উঠবেন তা এখন নিশ্চিত নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল তফসিল ঘোষণার পর এখন পর্যন্ত নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে ১৫টি একে স্বাগত জানিয়েছে, ১৭টি দল প্রত্যাখ্যান করেছে। ১২টি দল এখনো নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি।
আমার ধারণা, সময়ের সাথে সাথে আরও অনেকগুলো দল নির্বাচনী ট্রেনে চড়তে মরিয়া চেষ্টা চালাবে। অঙ্কের হিসাবে যাই হোক, মূল কথা হলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। তারা ইতিমধ্যে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রির মাধ্যমে নির্বাচনী লড়াইয়ে শামিল হয়েছে। তবে মাঠের মূল বিরোধী দল বিএনপি এখনো সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে আছে। তারা নির্বাচনের তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে।
নির্বাচন কমিশনের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে যদি বিবেচনা করেন, নির্ধারিত সময়ে তফসিল ঘোষণা করা ছাড়া তাদের করার কিছু নেই। এটা তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব। একদম যদি আইনের কথা বলেন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নির্ধারিত সময়ে তফসিল ঘোষণা করে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা। কারা নির্বাচনে আসবে, কারা আসবে না; এটা দেখা তাদের দায়িত্ব নয়। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য চেষ্টা নির্বাচন কমিশন কম করেনি।
তবে নির্বাচন কমিশন বারবার আমন্ত্রণ জানালেও বিএনপি তাদের ডাকে সাড়া দেয়নি। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি না, সবগুলো দল তাতে অংশ নেবে কি না, তা নিশ্চিত করা আসলে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। তারা নিজেরা আলাপ-আলোচনা করেই তবেই ঠিক করবে। নির্বাচন কমিশন তো কোনো রাজনীতির অংশ নয়। কাউকে জোর করে নির্বাচনে আনা বা কাউকে নির্বাচনের বাইরে রাখা তাদের কাজ নয়।
সবচেয়ে ভালো হতো, তফসিল ঘোষণার আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার পরিবেশ তৈরি হলে। কিন্তু অনেকদিন ধরেই আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করতে চায়। আর বিএনপির একদফা হলো, সরকারের পদত্যাগ। তো সরকার যদি পদত্যাগই করে তাহলে বিএনপি কার সাথে আলোচনা করবে? দুই পক্ষের শর্তের বেড়াজালে আটকে ছিল সংলাপের সম্ভাবনা।
তফসিল ঘোষণার আগে আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শর্তহীন সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশের প্রধান তিন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ জানিয়ে দিয়েছে, এখন আর সংলাপের সময় ও পরিবেশ নেই।
তাদের যুক্তি হলো, বিএনপি যেহেতু সরকার পতনের একদফা দাবিতে অগ্নিসন্ত্রাস চালাচ্ছে, তাই সংলাপের পরিবেশ তারাই নষ্ট করেছে। আর তফসিল ঘোষণার পর এখন আর সংলাপের সময় নেই। আওয়ামী লীগের যুক্তি মেনেও বলি, তারা যেহেতু টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে তাই তাদের দায়িত্ব বেশি। একটু ছাড় দিয়ে হলেও বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে পারলে তা দেশ, জনগণ ও গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক।
তফসিল ঘোষণা হলেও সব সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি। এখনো আলোচনার সুযোগ আছে। প্রয়োজনে তফসিল পেছানোর সুযোগও আছে। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সবাই যদি নিজেদের ইগো দূরে রেখে, শর্ত ভুলে গিয়ে সমঝোতার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসেন; এখনো একটি সুন্দর, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে জাতি। তাতে এক নিমেষে উড়ে যাবে শঙ্কার সব কালো মেঘ।
বিএনপি টানা ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু বিএনপি কোনো বিপ্লবী দল নয়। তারা একটি স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক দল। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও ফলাফল হয়েছে শোচনীয়। বিএনপি চেষ্টা করেও ২০১৪ সালে নির্বাচন প্রতিহত করতে পারেনি।
২০১৮ সালের নির্বাচনের পরও কোনো প্রতিরোধ গড়তে পারেনি। এখন তারা সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে মাঠে আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার মতো কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারেনি। নিকট ভবিষ্যতে পারবে, তেমন কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
বিএনপি এখন আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করে, কিছু যানবাহনে আগুন দিয়ে, জনগণকে জিম্মি করে দাবি আদায় করা যাবে না। তাহলে বিএনপি কী করবে? আরও এক মেয়াদ ক্ষমতা বা ক্ষমতা কাঠামোর বাইরে থাকার মতো সাংগঠনিক সক্ষমতা কি বিএনপির আছে।
আগেই বলেছি, বিএনপি কোনো বিপ্লবী দল নয়। তারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া একটি দল। এবার নির্বাচনে গেলেই যে বিএনপি ক্ষমতায় চলে যাবে তেমন কোনো গ্যারান্টি নেই। তবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিলে নেতাকর্মীরা চাঙা থাকেন। ক্ষমতায় যেতে পারলে ভালো, না গেলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসনে জিততে পারলে সংসদের ভেতরে-বাইরে আন্দোলন চালানো যায়।
দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, এটা প্রমাণের জন্য বারবার নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দিলে তো দিনশেষে বিএনপির ক্ষতি, আওয়ামী লীগেরই লাভ। আওয়ামী লীগ অনেক আগে থেকেই নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। তারা দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি করাও শুরু করেছে। এতদিন আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি নির্বাচনে আসবে ধরে নিয়েই।
আওয়ামী লীগের দুই ধরনের প্রস্তুতিই আছে। বিএনপি নির্বাচনে এলে জাতীয় পার্টিসহ মহাজোট হিসেবে আওয়ামী লীগ তাদের মোকাবিলায় মাঠে নামবে। আর না হয় হয়তো জাতীয় পার্টি আলাদাভাবেই নির্বাচন করবে, যাতে মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আগেই তৃণমূল বিএনপিকে তৈরি করে রেখেছে সরকার।
আর নির্বাচন এলেই বাংলাদেশের কিছু ইসলামি দল মাঠে নামে নানা সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার ধান্ধায়। তারা কখনো এই দলের সাথে, কখনো ঐ দলের সাথে দর কষাকষি করে। ভোটের মাঠে তাদের অবস্থান নড়বড়ে হলেও আওয়াজ তাদের অনেক লম্বা।
তবে বছরের পর বছর বাংলাদেশের মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছে, ধর্ম নিয়ে তাদের আবেগ থাকলেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। তাই তো এই দেশেও ইসলামি দলগুলোর ভোট ভগ্নাংশের বেশি নয়। বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে নাই আসে, তাহলে কি নির্বাচনের ট্রেন থেমে থাকবে? নির্বাচনের পরে কী হবে, যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে জানি না; তবে নির্বাচনের ট্রেনের যাত্রা থামার কোনো সুযোগ নেই। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার স্বার্থেই এই ট্রেন এগিয়ে যাবে।
লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।