“সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়”- সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ১৯৭২ সালে প্রণীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের পররাষ্ট্রনীতিতে লিপিবদ্ধ এ অনুচ্ছেদকে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণপূর্বক দেশের স্বার্থকে সমুন্নত রেখে প্রতিবেশী ও অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা অত্যন্ত বিচক্ষনতার পরিচয় দিয়েছেন এবং এর আলোকে প্রায় সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক কূটনৈতিক সফলতা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন ও রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে সকল ক্ষেত্রে সাফল্যের ঝুলি ভরা থাকলেও ছিটমহল সমস্যার সমাধানের সফলতা মানবিক কারনে এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত হয়েই থাকবে। ছিটমহল সম্পর্কে আমরা কমবেশি সবাই জানি। শব্দটির সূচনা মূলত ১৯৪৭ সালে সিরিল রেডক্লিফের মানচিত্র বিভাজন থেকেই। ছিটমহল বিনিময় চুক্তি সম্পাদন ও বাস্তবায়নের গুরুত্ব, মর্মার্থ বুঝতে হলে এ সম্পর্কিত দীর্ঘ ইতিহাস আমাদের জানতে হবে।
১৭৫৭-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছর চলে ইংরেজদের দ্:ুশাসন-শোষণ। এসবের বিরূদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন, লড়াই-সংগ্রামের পর ভারতীয় উপমহাদেশকে স্বাধীনতা দেয়ার জন্য ১৯৪৭ সালের ১৫ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে “ইন্ডিয়ান্স ইন্ডিপেন্ডন্স অ্যাক্ট-১৯৪৭” পাস হয়। এ প্রেক্ষিতে ভারতবর্ষে নিযুক্ত শেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের সময়ে বাংলা ও পাঞ্জাবের সীমারেখা নির্ধারণের পরিকল্পনা করেন। তার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নিমিত্তে সীমানা নির্ধারণ কমিশন গঠন করেন এবং ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল রেডক্লিফকে এই কমিশনের প্রধান করেন।
এ প্রেক্ষিতে সিরিল রেডক্লিফ ১৯৪৭ সালের ৮ জুলাই লন্ডন থেকে ভারতে আসেন। তিনি মাত্র ৬ সপ্তাহ কাজ করে ১৩ আগস্ট সীমানা নির্ধারণের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন এবং ১৬ আগস্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় সীমানার মানচিত্র। কিন্তু রেডক্লিফের অদূরদর্শীতা, কমিশনের সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তা, স্থানীয় জমিদারদের লোভ এবং তৎকালীন কংগ্রেস, মুসলীম লীগ ও হিন্দু মহাসভার খামখেয়ালিপনায় সীমানা নির্ধারণের কাজটি সঠিকভাবে করা হয়নি। ফলে এক দেশের ভূখন্ডে থেকে যায় আরেক দেশের জনগণ। সীমান্ত অঞ্চলে শুরু হয় “নিজভূমে পরবাসী” পরিচয়ে ছিটমহলবাসীর বসবাস।
ছিটমহল হচ্ছে মূলত এক দেশের ভিতর অন্য দেশের ভূখন্ড। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সর্বমোট ১৬২ টি ছিটমহল রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ছিটমহল ছিল ১১১ টি; ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের ছিটমহল ছিল ৫১ টি যার মোট জমির পরিমান হচ্ছে যথাক্রমে ১৭,১৬০ ও ৭,১১০ একর। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ভারত-পাকিস্তান সীমানা নির্ধারণের সময় অনাকাঙ্খিতভাবে সৃষ্ট উভয় দেশের মালিকানাধীন এই ছিটমহলগুলোকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে রাখা হয় রাষ্ট্রের সার্বভৌম সীমার বাইরে। ফলস্বরূপ মালিকানা সংক্রান্ত সংঘর্ষে ছিটমহলের মানুষদের তৈরি হয় পরিচয়- সংকট। তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ। এক রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে আশ্রিত অন্য রাষ্ট্রের মালিকানাধীন নিরপরাধ জনগন কার্যত হয়ে পড়েন রাষ্ট্রহীন মানুষ!
২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের ভিতর ভারতের এবং ভারতের ভিতর বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোতে যথাক্রমে ৩৭,৩৩৪ এবং ১৪,২১৫ জন লোক বাস করে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রায় অর্ধলক্ষাধিক ছিটমহলবাসির দৈনিক আয় ছিল মাত্র ১৭ টাকা। মানুষের মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ যোগাযোগ ব্যবস্থা, সুপেয় পানি, বিদ্যুৎ, ভোটাধিকার, কর্মসংস্থান এর সুযোগ-সুবিধা থেকে প্রায় বঞ্চিত ছিলেন তারা। ছিটের ছেলে-মেয়েরা যতই মেধাবী হোক না কেন, তারা আসল বাবা-মার পরিচয়ে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি কিংবা মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপ করতে পারত না। কারণ, উক্ত বিদ্যালয় বা পরীক্ষা-বোর্ডের দেশে পরীক্ষার্থী ও তাদের মা-বাবা ভিনদেশী। তাই ছিটের মেধাবি শিক্ষার্থীকে বোর্ড পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হলে মিথ্যা পিতৃপরিচয় জোগাড় করতে হতো।
শুধু তাই নয়, সন্তানসম্ভবা বধূ নিকটতম হাসপাতালে গেলে ভর্তি নিত না। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, অন্তঃসত্ত্বা বধূরা কি হাসপাতালে যেত না? অবশ্যই যেত। কিন্তু যাওয়ার সে পথ সুগম ছিল না। হাসপাতালে ভর্তি হতে দেশহীন দেশের গৃহবধূকে অপরিচিত কোন পর পুরুষের বউয়ের পরিচয়ে ভর্তি হতে হত। যে পুরুষ মানুষটি হাসপাতালের দেশের স্বীকৃত নাগরিক।
শিশুর জন্মের পর হাসপাতাল থেকে যে কার্ড দেওয়া হত, তাতে সদ্যোজাত শিশুটির বাবা হিসাবে সেই পুরুষটির নামই থাকত। সন্তানপ্রসবা নারীর স্বামীর পরিচয় কিংবা পরীক্ষার্থীর অভিভাবকের পরিচয় মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বিক্রি হত। কোন মেয়েকে অপহরণকারীরা তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করলে, সে অভিযোগ নিকটতম পুলিশফাঁড়িতে নিত না। কারণ, দেশবিহীন ছিটের মেয়েকে ফাঁড়ির দেশ ঐ দেশের নাগরিক বলে মানত না। এমনকি, সীমান্তের প্রহরীদের কাছে নির্মমভাবে নির্যাতিত হওয়াও বাদ যায়নি ছিটমহলবাসীদের (৮ এপ্রিল ২০১৯, আনন্দবাজার পত্রিকা)। কতই আমানবিক, অভিশপ্ত ছিল তাদের জীবন যা ভাবলেই গা শিউরে উঠে।
প্রকৃতপক্ষে, ছিটমহলবাসী রাষ্ট্রের নির্বুদ্ধিতার ফল ভোগ করত বিনা দোষে। তাদের ছোট্ট অসহায় জীবনের উপর যেকোন মুহূর্তে ধেয়ে আসত চরম বিপর্যয়। তাই নাগরিকত্ব ও পতাকা-প্রতীকহীন এই মানুষগুলির কত শত আশা-আকাঙ্ক্ষা, হতাশা, বঞ্চনা, নির্যাতন, নিষ্পেষণ, নিপীড়ন, মানবেতর জীবন- এসবকে নিত্যসঙ্গী করে ছিটমহলের জীবনপ্রবাহ বহমান ছিল দীর্ঘ ৬৮ বছর। এত কষ্টে ছিটমহলবাসী দীনাতিপাত করলেও তাদের নিয়ে কেউ ভাবেনি। সকলেই জমি চেয়েছিল, কিন্তু কেউ চায়নি এই অসহায় মানুষদের কষ্টের অবসান।
ছিটমহল বিনিময় সংক্রান্ত কোন আইন পাশ হলে স্বাভাবিকভাবেই ভারতের অংশটুকু বাংলাদেশ ব্যবহারের অধিকার পেয়ে যাবে এবং পাশাপাশি ভারতও বাংলাদেশের অংশটুকু পেয়ে যাবে। এখানেই বাধে বিপত্তি। কারন ছিটমহল বিনিময় চুক্তি পাশ হলে বাংলাদেশ ভরতের চেয়ে প্রায় ১০,০০০ একর জমি বেশি পাবে। যদিও ছিটমহল বিনিময় চুক্তির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল ছিটমহলবাসীর নাগরিক পরিচয় ও স্বাভাবিক জীবন। কিন্তু দু:খজনকভাবে জমির হিসাব এখানে মূখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ানোয় রাষ্ট্রপ্রধানরা সর্বদা চুপ থেকেছেন। কিন্তু চুপ থাকতে পারেননি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সুযোগ্য তনয়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই তো ১৯৭৪ সালে ভারত সফরকালীন বঙ্গবন্ধু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দুই দেশের বিরাজমান সীমান্ত সংকট নিয়ে কথা বলেন। সেখানে তিনি রেডক্লিফের কার্যক্রমকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ছিটমহলবাসীদের দূর্বিষহ জীবন-চিত্র তুলে ধরেন।
১৯৭৪ সালের ১৬ মে দুজনের মাঝে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা ‘৭৪ এর মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি’ নামে পরিচিত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ৩য় সংশোধনী জাতীয় সংসদে ( ২৩ নভেম্বর, ১৯৭৪) বাংলাদেশ সরকার মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি পাশ করলেও ভারত সরকার পাশ করেনি। দূর্ভাগ্যবশত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দুই রাষ্ট্রের আর কোন সরকার প্রধানই ছিটমহল সমস্যা সমাধানে তেমন আন্তরিক ছিলেন না। তাই ‘৭৪ এর চুক্তির পর ছিটমহলবাসীর মনে যে কিঞ্চিৎ আশার আলো ফুটে উঠেছিল, অংকুরেই তা বিনষ্ট হয়ে যায়।
মানবতার মা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর চুক্তিটি বাস্তবায়নের প্রতি জোর দেন। এ ব্যাপারে ভারত সরকারের সাথে কয়েক দফায় আলোচনা করেন। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ আবার ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুনরায় এ সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচনা শুরু করেন।
২০১১ সালের হাসিনা- মনমোহন প্রটোকল স্বাক্ষর তার স্পষ্ট প্রমাণ। সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সীমান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার ২০১৩ সালে এ সংক্রান্ত একটি বিল সংসদে উত্থাপন করে। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি সংসদ সদস্যেদের বিরোধিতায় পাশ করা সম্ভব হয়নি তখন।
এরপরেও দমে যান নি অদম্য শেখ হাসিনা। অত্যন্ত বিচক্ষনতার সহিত ঠান্ডা মাথায় প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। যে বিজেপির তীব্র বিরোধিতার কারনে ২০১৩ সালে এ বিল পাশ হয়নি, সেই বিজেপি নেতৃত্বাধীন মোদি ২০১৪ সালে ভারতে সরকার গঠন করলেও আশাহত হননি আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান। বরং দ্বিগুন উদ্যম নিয়ে দারুন কুটনৈতিক দক্ষতায় এ সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে মোদিকে রাজি করান। এরই ধারাবাহিকতায় বিজিবি নেতৃত্বাধীন মোদি সরকার সীমান্ত সমস্যা সমাধানের লক্ষে ৭ মে ২০১৫ সালে ভারতীয় সংসদের নিম্ন কক্ষ লোকসভায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার স্থল সীমান্ত চুক্তি সংক্রান্ত বিল ৩৩১-০ ভোটের ব্যবধানে সংবিধানের ১০০ তম সংশোধনীর মাধ্যমে পাশ হয়। এ চুক্তি কার্যকর হয় ৩১ জুলাই’ ২০১৫ সালের মধ্য রাত থেকে। এই চুক্তির মাহাত্ম বলে শেষ করা যাবে না। কেননা, এই চুক্তির মাধ্যমে ৩০২ বছর ধরে চলমান সীমান্ত সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয় এবং ছিটমহলে বসবাসকারী প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ ফিরে পায় নাগরিকত্ব।
৬৮ বছরের বন্দীজীবনের অবসান হয়, অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবন পিছনে ফেলে ফিরে পায় আলোকিত জীবন। চুক্তি পরবর্তী বাংলাদেশের অংশের ছিটমহলের মানুষের মৌলিক ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিপুল অর্থ বরাদ্ধ দিয়ে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ করেন। নির্মান করেন স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল। থাকার জন্য গৃহ নির্মান করে দেন। মোদ্দাকথা, মানবেতর ও বদ্ধ জীবন থেকে এই মানুষগুলিকে মুক্তি দিয়ে নাগরিক মর্যাদা প্রদানপূর্বক সকল অধিকার নিশ্চিতের এক অনন্য নজির স্থাপন করলেন মমতাময়ী শেখ হাসিনা। তাঁর এ মহান উদ্যোগ সমহিমায় স্মরিত হবে যুগ থেকে যুগান্তরে, কাল থেকে কালান্তরে। তাঁকে ছিটমহলবাসি কৃতজ্ঞতায় রাখবেন আজীবন।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগবরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।