আন্দোলন নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আর শঙ্কায় বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। এক দিকে নেতৃত্বের সংকট, আরেক দিকে সঠিক পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তের অভাবে আন্দোলনে নামার মনোবল হারিয়ে ফেলছেন তারা। নির্বাচনমুখি দল হলেও বিএনপির নির্বাচনের পথ পরিহার করে সহিংসতার পথ বেছে নেওয়ায় দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা নেমে এসেছে। দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এমনটি জানা গেছে।
সরকারের পতন, নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর এক দফা দাবিতে টানা প্রায় এক বছর ধরে আন্দোলন করে আসছে বিএনপি। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশের ডাক দেয় বিএনপি। একই দিনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকার বিরোধী জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামী ও অন্য দলগুলোও সমাবেশের ডাক দেয়।
কিন্তু সমাবেশ শুরু হওয়ার হঠাৎ করেই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা যখন সমাবেশ মঞ্চে বক্তব্য রাখছিলেন তখন সমাবেশের কাকরাইল প্রান্তে দলীয় নেতাকর্মীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। সেই সংঘর্ষ মুহূর্তেই কাকরাইল ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে নয়াপল্টন, শাহাজাহানপুর, আরামবাগ, রাজারবাগসহ আশপাশের এলাকায়। সংঘর্ষের একজন পুলিশ সদস্য ও যুবদলের একজন কর্মী নিহত হওয়ার পাশাপাশি আহত হয়েছেন অনেকে। সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনাও ছিলো ভয়াবহ। এছাড়াও পুলিশ হাসপাতালে হামলা, গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা হতবাক করে দেয় অনেককে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ওইদিন কাকরাইল মসজিদের বিপরীতে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, ভাঙচুরের ঘটনা ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
সমাবেশ করতে এসে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের একটা বড় অংশই হতবাক হয়েছেন। তাদের ভাবনাতেই ছিলো না এমন ঘটনা ঘটবে। তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলছেন, ২৮ অক্টোবরের ঘটনা বিএনপিকে অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে। নেতৃত্বের দুর্বলতার এবং অদূরদর্শীতার কারণেই সেদিন ঘটনা ঘটেছে।
ময়মনসিংহ জেলা বিএনপির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা এক বছর ধরে যেভাবে দলটিকে এগিয়ে এনেছিলাম, সরকারের বিরুদ্ধে জনমানুষের একটা আস্থা তৈরি করেছিলাম ২৮ অক্টোবরের ঘটনা আমাদেরকে শেষ করে দিয়েছে।
নেত্রকোনা জেলা যুবদলের এক নেতা বলেন, সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ একটা সমাবেশ যেভাবে অতিউৎসাহী নেতাকর্মীদের কারণে সহিংসতায় রূপ নিয়েছে তাতে দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে হাতাশা দেখা দিয়েছে।
দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলছেন, ২৮ অক্টোবরের ঘটনার পর থেকে তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যার ফলে এখন দলের কোনো কর্মসূচিতেই মাঠ কর্মীদের পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। এর প্রমাণও ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। দল হরতাল ও অবরোধের মত কঠোর কর্মসূচি দিলেও দেশের বেশিরভাগ এলাকাতেই নেতাকর্মীদের হরতালের পিকেটিং বা অবরোধ সফল করে তুলতে মাঠে দেখা যায়নি।
বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, দলকে চাঙ্গা করতে এখন কৌশলের কোনো বিকল্প নেই। হুটহাট সিদ্ধান্ত নিয়ে এমন কোনো কর্মসূচি না দেওয়ার পক্ষে মত দিচ্ছেন তারা। বিএনপি কর্মীরা বলছেন, দলীয় নেতারা কর্মসূচী ঘোষণা দিয়েই শেষ। এটি কিভাবে, কারা সফল করে তুলবে সে নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো পরিকল্পনা নেই। তারা আরও বলছেন, যেহেতু আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়ানো যাচ্ছে না সেক্ষেত্রে আরও দূরদর্শী চিন্তা করতে হবে। আত্মঘাতী সিদ্ধান্তে নিয়ে দলীয় কর্মীদের গুলির মুখে ঠেলে না দেয়ার কথা বলছেন তারা।
এদিকে বিএনপি একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক মহলের ‘আহ্বান ও সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ওই দিন থেকে আজ অবধি সরকারের কঠোর অবস্থান চিন্তায় ফেলে দিয়েছে বিএনপিকে। মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার প্রতিবাদে ‘হরতাল-অবরোধ’এর মত কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার পরও সরকারের ‘আচরণ’ নরম না-হয়ে বরং আরও কঠোর হয়েছে। এটা দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের শুধু চিন্তায় ফেলেছে না, মনোবলও ভেঙ্গে দিয়েছে।
ওই সূত্র আরো জানায়, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে একেবারে মাঠে কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেয়- তৃণমূলের এমন সংগঠকদের একের পর এক গ্রেপ্তার চলছে। ফলে দলে দেখা দিয়েছে নেতৃত্বের সংকট। এমতাবস্থায় অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি চালিয়ে নেওয়া যাবে কি-না দলের মধ্যে এমন আলোচনা এসেছে।
অবশ্য বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা এ ব্যাপারে বলছেন ভিন্ন কথা। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচীর শেষ দিন গত বৃহস্পতিবার বিকেলে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তাদের অবরোধ কর্মসূচি সর্বাত্মক সফল হয়েছে। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে সন্তুষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এই সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত বিএনপির আন্দোলন চলবে জানিয়ে তিনি ৫ ও ৬ নভেম্বর (রবি ও সোমবার) আরও দুই দিনের অবরোধ কর্মসূচী ঘোষণা করেন। বিজয় না হওয়া পর্যন্ত ‘একদফা’র আন্দোলন চলতেই থাকবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, ‘আর পিছু ফেরার সময় নেই। জুলুম-নির্যাতন, মিথ্যা মামলা-হামলা, গ্রেফতার করে আন্দোলন স্তব্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। বিএনপির প্রতিটি কর্মীই নেতার ভূমিকা পালন করে এ আন্দোলনে সফলতা আনবে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার পতনের একদফা দাবিতে আমরা শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অটল রয়েছি। যে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলছে তা অব্যাহত থাকবে। দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনকে নস্যাৎ করা যাবে না।’