পাট বাংলাদেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার শাসনামলেই অনুধাবন করেছিলেন ‘পাটের গবেষণায় বিশেষ গুরুত্বারোপ এবং পাট উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করা হলে জাতীয় অর্থনীতিতে পাট সম্পদ সময়োপযোগী ভূমিকা পালন করতে পারে’। বিশ্বব্যাপী আঁশ উৎপাদনকারী ফসল হিসেবে তুলার পরেই পাট ও পাট জাতীয় আঁশ ফসলের অবস্থান। বিশেষত, সোনালি আঁশ খ্যাত ‘পাট’-এর সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির সম্পর্ক অনেক গভীর। বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে পাটের ভূমিকা অপরিসীম। পরিবেশবান্ধব তন্তু (ফাইবার) হিসেবে পাটের চাষ ও পাট পণ্যের ব্যবহার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করেছে।
এই সম্ভাবনাকে সামনে রেখে বর্তমান সরকার পাটের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে পাট পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি ও বহুমুখী পাটজাত পণ্যের উদ্ভাবন এবং ব্যবহার সম্প্রসারণে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার পাটজাত পণ্যকে ইতিমধ্যেই বর্ষপণ্য-২০২৩ এবং সোনালি আঁশ খ্যাত পাটকে কৃষিপণ্যের স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছে। পাট একটি পরিবেশবান্ধব উদ্ভিদ যার পুরো অংশই ব্যবহারযোগ্য। বাংলাদেশে প্রধানত দেশি ও তোষা পাট এবং পাট জাতীয় আঁশ ফসল কেনাফ ও মেস্তা চাষ হয়ে থাকে, যা ১১০-১২০ দিন সময়ের মধ্যেই কাটা হয়। বর্তমানে দেশের প্রায় ৪৫ লক্ষ কৃষক পাট চাষে জড়িত।
আশির দশকে প্রায় ১০ লক্ষ হেক্টর জমিতে ৬০-৬৫ লক্ষ বেল (১ বেল = ১৮০ কেজি) পাট উৎপাদিত হতো। পরবর্তীতে ৯০-এর দশকে তা হ্রাস পেয়ে ৪৫ লক্ষ বেল-এ নেমে যায়। বর্তমান সরকার কর্তৃক গৃহীত কৃষি ও কৃষকবান্ধব পদক্ষেপের কারণে ২০১০ সালে ৭-৮ লক্ষ হেক্টর জমিতে প্রায় ৮০-৯০ লক্ষ বেল পাট উৎপাদিত হয়।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ০৪ শতাংশ আসে পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে। এছাড়া পরোক্ষভাবে কৃষি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার দিক বিবেচনায়, এক হেক্টর জমিতে পাট চাষ পরবর্তী প্রায় ৮ মেট্রিক টন জৈব পদার্থ মাটিতে যুক্ত হয় যা মাটির স্বাস্থ্য সংরক্ষণসহ উর্বরতা বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ১৯৫১ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়েরে উদ্যোগে ঢাকায় কেন্দ্রীয় পাট কমিটি গঠিত হয় এবং ১৯৫৭ সালে তেজগাঁওয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি পাট গবেষণা ইন্সটিটিউট। বর্তমানে ঢাকার শেরে-বাংলা নগরের মানিক মিয়া এভিনিউ-তে অবস্থিত এই গবেষণাগার বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিজেআরআই) নামে পরিচিত।
অদ্যাবধি, বিজেআরআই পাট ও পাট জাতীয় ফসলের ৫০টির উপরে জাত উদ্ভাবন করেছে। বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায় পাট উৎপাদন হলেও ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, যশোর, ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও জামালপুরই প্রধান পাটচাষ অঞ্চল। সবচেয়ে বেশি পাট উৎপাদিত হয় ফরিদপুর জেলায়।
পাট ও পাট পণ্যের উন্নয়নে কাজ করা বিজেআরআই, জুট ডাইভারসিফিকেশান প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) ও বহুমুখী পাট পণ্য উৎপাদনকারী দেশীয় উদ্যোক্তাগণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রদর্শনী, মেলা, সেমিনার, সভা ও প্রচারণামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলার সেই পাট-কেন্দ্রিক কৃষি অর্থনীতির পূনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনকারী উদ্যোক্তারা দেশের শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। এই পর্যন্ত ২৮২ ধরনের পরিবেশবান্ধব বহুমুখী পাট পণ্যের উৎপাদন ও এর ব্যবহারের মাধ্যমে একটি টেকসই পরিবর্তনের ঢেউ দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়েছে। উল্লেখ্য, পাটের সোনালি আঁশ ও রুপালী কাঠি (পাটকাঠি) দুয়েরই রয়েছে অপার সম্ভাবনা। সোনালি আঁশ নামে পরিচিত বাংলাদেশের পাট পরিবেশবান্ধব এবং বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য একটি আঁশ। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্য অনেক আঁশের সঙ্গে ব্যবহার করা যায়।
পাটের বস্তা এখনো দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। অন্য ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে সুতা, পাকানো সুতা, চট, জিওটেক্সটাইল, কার্পেট ব্যাংকিং, কাগজ তৈরির পাল্প, কৃত্রিম রেয়ন, পর্দার কাপড়, কুশন কভার এবং গরম কাপড় তৈরির জন্য উলের সঙ্গে মিশিয়েও পাট ব্যবহার করা হয়।
উপজাত হিসেবেও পাটের আঁশের বহুমুখী ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে প্রসাধনী, ওষুধ, রং ইত্যাদি খাত। সম্প্রতি পাট থেকে জুট পলিমার তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেন ড. মোবারক আহমেদ খান যা ‘সোনালি ব্যাগ’ নামে পরিচিত। পাটের কচি পাতা শাক হিসেবেও খাওয়া হয়। অন্যদিকে ঘরের বেড়া, ছাউনি এবং জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার হয় পাটকাঠি। বাঁশ এবং কাঠের বিকল্প হিসেবে পার্টিকেল বোর্ড, কাগজের মণ্ড ও কাগজ তৈরিতেও পাটকাঠি ব্যবহার হয়। পাটকাঠি পুড়িয়ে তৈরি কার্বন বা চারকোল (কয়লা) জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই চারকোল অনেক দেশেই (যেমন চীন, ব্রাজিল, তাইওয়ান) রপ্তানি হয়, যেখানে এটি উন্নত প্রযুক্তির সহায়তায় কম্পিউটার প্রিন্টারের কালি, ফটোকপি মেশিনের কালি ও কসমেটিক্স উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং এ থেকে উৎপাদিত দ্রব্যাদি আমরা অধীক দামে দেশে আমদানি করে থাকি। এছাড়া পাটকাঠি দিয়ে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই বেড়া তৈরি, গাড়ির ডেস্কবোর্ড তৈরি করা হয়।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, মায়ানমার, চীন, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ব্রাজিল এবং অন্যান্য আরও কয়েকটি দেশে পাটের চাষাবাদ হয়। চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮০ শতাংশ পাট বিশ্ববাজারে রপ্তানি হতো। পরবর্তীতে, সত্তর-আশির দশকে পৃথিবীর অন্যান্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতা এবং বিশ্ববাজারে কৃত্রিম তন্তুর আবির্ভাবের কারণে পাট রপ্তানি নিম্নমুখী হয় এবং বর্তমানে বিশ্ব চাহিদার শতকরা ২৫ ভাগ পাট বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা হয়।
বাংলাদেশ রপ্তানি ব্যুরো (ইপিবি) এর তথ্য অনুযায়ী, বিগত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে পাট পণ্য থেকে রপ্তানী আয় হয়েছে ৬৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার (প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা), যা পাটপণ্যের বহুমুখীকরণ ও মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে বহুগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। সেই লক্ষ্যে, পাট উৎপাদন থেকে শুরু করে পাট সংগ্রহ, সংরক্ষণ-এবং যুগোপযোগী পণ্য তৈরিসহ সবকিছুতে আরও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। তাই পাটের চাষ বৃদ্ধি করতে কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ সুবিধাসহ যাবতীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে সহায়তা করতে হবে।
পাটের ব্যাপক চাষাবাদ, বন্ধ পাটকলগুলো চালু করা, পাটের বহুমুখী ব্যবহার ইত্যাদির ফলে কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হবে। এর ফলে পাট চাষিদের মধ্যে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা বাড়বে এবং উত্তরোত্তর বাড়বে পাট চাষ। এছাড়া বহুমুখী পাটপণ্য তৈরির এই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সম্ভাবনা অপরিসীম। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, আত্ম-কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে সম্ভাবনাময় পাটপণ্য বহুমুখীকরণ খাতটি। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে এক শক্তিশালী স্মার্ট অর্থনীতি গড়ে তুলতে সক্ষম এই দেশের সোনালি আঁশ পাট। ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে একটি উন্নত অর্থনীতির দেশে রূপান্তর করার স্বপ্ন আজ দ্বারপ্রান্তে।
লেখক: অধ্যাপক, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।