বিএনপির দুটি ডেডলাইন। এক ১০ ডিসেম্বর, দুই ২৮ অক্টোবর। এই দুই তারিখে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হবে বলে ঘোষণা দেয় বিএনপি। ১০ ডিসেম্বর কিছুই হয়নি। একই ভাবে ২৮ অক্টোবরের পরও এখনও ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা হয়েছে, তার দায় এড়াতে পারেনা দলটি। রাজনীতির নামে এই আগুন সন্ত্রাসের কারণে টানা
‘শান্তিপূর্ণ’আন্দোলন করা এই দলটির নেতারা এখন ছন্নছাড়া। গ্রেপ্তার হয়েছেন অনেক কেন্দ্রীয় নেতা। আত্মগোপনে প্রায় নেতা। স্যোশাল মিডিয়াতে অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে দায় ছাড়ছে বিএনপি। এতে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে মাঠ পযায়ের নেতাকর্মীরা।
২৮ অক্টোবরের সহিংসতার পরই গ্রেপ্তার হন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জম হোসেনসহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য নেতাদের আর মাঠে দেখা যায়নি। দলীয় কার্যালয়ও তালা মেরে রাখা হয়েছে। শুধু গোপন স্থান থেকে স্যোশাল মিডিয়ায় লাইভে এসে সরকারের সমালোচনা করে কর্মসূচি ঘোষণা করছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খানসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। তারা কোথায় আছেন কেউ জানেন না। অথচ তারা জনসভায় গরম গরম কথা বলে কর্মীদের উজ্জিবিত করেছেন। সরকারের পদত্যাগ না করা পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাবেন না বলেও নেতাকর্মীদের সামনে প্রতিজ্ঞাও করেছিলেন।
নিজ দলের নেতাদের উপর ভরসা রাখতে পারছেন না মাঠ পর্যায়ের বিএনপির কর্মীরা। কারণ ঈদের পর আন্দোলন, ৩১ দফা-১০ দফা-১ দফা আন্দোলন, ১০ ডিসেম্বরের পরে খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলবে এরকম অবান্তর কথাবার্তা আর বারবার আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ায় অনেক আগেই বিএনপির হাই কমান্ড থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল তারা। সর্বশেষ ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ করে চূড়ান্ত আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার হঠানো হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিএনপির হাই কমান্ড। এতে নতুন করে তৃণমূলের কর্মীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু ২৮ অক্টোবর পার হয়ে গেলেও সরকার পতনের কোন নামগন্ধ নেই। বরং ২৮ তারিখই হঠাৎ করে সমাবেশ স্থগিতের ঘোষণা দিয়ে সমাবেশস্থল থেকে একপ্রকার পালিয়ে যেয়ে তৃণমূলের নেতা কর্মীদের হতাশ করেছিল বিএনপির হাই কমান্ড।
কেন্দ্রীয় নেতাদের মতবিরোধ, হরতাল-অবরোধে কর্মীদের মাঠে নামিয়ে দিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের রাজপথে অনুপস্থিতি, সব মিলিয়ে এবার পুরোপুরি হতাশায় বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। এর প্রমাণও ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। দল হরতাল ও অবরোধের মত কঠোর কর্মসূচি দিলেও দেশের বেশিরভাগ এলাকাতেই নেতাকর্মীদের হরতালের পিকেটিং বা অবরোধ সফল করে তুলতে মাঠে দেখা যায়নি।
সাধারণত রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতারা সব সময় থাকেন সামনের সারিতে। কারণ তিনি তাঁর দলের কর্মীদের পথপ্রদর্শ। ইতিহাসও তাই বলে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সামনের কাতারে ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের আন্দোলনে রাজপথে সব সময় সক্রিয় ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে জনতার কাতারে ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রাজপথে আন্দোলনও করেছেন তিনি।
২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপিবিরোধী ধারাবাহিক সংগ্রামে শেখ হাসিনার সাথে রাজপথে মিছিলের সামনে থেকেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। পুলিশের নির্যাতন সহ্য করেও মাঠ ছেড়ে যাননি তারা। শুধু ব্যতিক্রম বিএনপির ক্ষেত্রে। দলটির নেতারা বড় বড় কথা বলে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অথচ আন্দোলনের সময় মাঠে নেই কোনো নেতা। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও বেশিরভাগ নেতা আত্মগোপনে চলে গেছেন। কর্মীদের কথা তারা ভাবছেন না তারা। বিএনপির মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে এখন হতাশা বিরাজ করছে। অনেকে বলছেন, বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতাদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে- কর্মীদের গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক আদর্শ না থাকলে কোনো নেতাই কর্মীদের কাতারে থাকেন না। যাদের দেশ ও কর্মীদের জন্য দরদ নেই তারাই এমন কর্মকাণ্ড করতে পারেন। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, কর্মীদের তারা ক্ষমতায় যাওয়ার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। তথ্য প্রমাণ বিশ্লেষণ করে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) এমনটিই ইঙ্গিত করেছেন।
মঙ্গলবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন, গত ২৮ অক্টোবর কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সদস্য সচিব আমান উল্লাহ আমান তার অনুসারীদের নিয়ে নয়াপল্টনের মঞ্চের পাশে অবস্থান নেয়। মঞ্চে অবস্থিত বিএনপির এবং ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনা ছিল পুলিশের ওপর বর্বরোচিত ও নৃশংস হামলার মাধ্যমে পুলিশের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়া। প্রয়োজনে এক বা একাধিক পুলিশ সদস্যকে হত্যার মাধ্যমে দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা, যাতে করে একটি নতুন ইস্যুর সৃষ্টি হয়।
সিটিটিসির তথ্য বলছে, অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে কর্মীদের দিয়ে নাশকতা চালিয়েছে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের কথা তারা চিন্তা করেনি। অথচ তাদের নেতা হওয়া উচিত, যারা কর্মীদের ভালো-মন্দ বোঝেন। কর্মীদের বিপদে সবার আগে সামনে দাঁড়ান। বিএনপি নেতাদের অবস্থার ঠিক তার উল্টো। নিজেদের মঙ্গলের জন্য সবার আগেই তারাই আত্মগোপনে গেছেন। কর্মীদের কথা কেউ ভাবছেন না। এখন কর্মীরাও সেটি বুঝতে পারছেন। ধারাবাহিক অবরোধ কর্মসূচি দিলেও সারাদেশে মাঠ পর্যায়ে দেখা মিলছে না কর্মীদের। এসব ঘটনা থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের বোঝা উচিত, তৃণমূলের কর্মীরা কী চাইছেন। শুধু গোপন স্থানে থেকে কিংবা লন্ডন থেকে ভিডিও বার্তা দিয়ে এখন তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা করতে পারবেনা দলটি।
বিএনপি দুই বার ডেডলাইন দিয়েও বর্তমান সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করাতে পারেনি। এতদিন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার যে দাবি বিএনপি করে আসছিল ২ নভেম্বর পার হয়ে যাওয়ায় সেই সুযোগ আর নেই। বর্তমানে সরকার চাইলেও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আর চালু করতে পারবেনা। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হলে সংসদে দুই তৃতীয়াংশের বেশি সদস্যের সমর্থনে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কিন্তু ২ নভেম্বর বর্তমান জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন সমাপ্ত হয়ে গেছে। তাই এখন সরকার রাজী হলেও বিএনপির দাবি অনুসারে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আইনগতভাবে করার সুযোগ নেই।
আত্মগোপনে থাকা বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে এখন দুটি পথ খোলা- হয় নির্বাচনে অংশ নিতে হবে অথবা নির্বাচন বর্জন করতে হবে। বিএনপি যেহেতু নির্বাচন মুখী দল তাই তৃণমূল নেতা-কর্মীদের আগ্রহ নির্বাচন নিয়ে। এমনিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বর্জন করায় অনেকে নেতাকর্মী হতাশ হয়েছেন। কেউ কেউ দলের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করেছেন, অনেকে জিতেছেনও। আগামী জাতীয় নির্বাচনে যদি বিএনপি অংশগ্রহণ না করে, তাহলে দলের কর্মীদের ধরা রাখা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন জেলা পর্যায়ের নেতারা। এখন বিএনপি কী মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কথা বিবেচনা করবে নাকি ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন বর্জন করবে সেটিই দেখার বিষয়।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।