অর্থনৈতিক সক্ষমতা রক্ষায় এখন আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে বর্তমান সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে এবং অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর পরবর্তীতে স্মার্ট বাংলাদেশের যে স্লোগান তাতে করে এই সক্ষমতা বৃদ্ধির ধাপ আরো বেশি বেগবান হয়েছে। বিগত এক দশকের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রায় এক দশক পরে দেশের কৃষিখাতে কর্মক্ষম মানুষের অংশগ্রহণের পরিমাণ ৪৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। শুধু বিগত পাঁচ বছরে কৃষিখাতে এ সংখ্যা বেড়েছে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এরকম ভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাত নানাপরিক্রমায় এগিয়ে যাচ্ছে। দেশে বেকারত্বের হার ও উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে।
কৃষি বিপণন সহ বিভিন্ন সেবা খাতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যাবহারের মাধ্যমে তরুণদের মধ্যে অনেকেই নিত্য নতুন ব্যবসা ও ফ্রিল্যান্সীং এর আওতায় এসেছে। ফলে ঘরে ঘরের বাইরে এক ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এই প্রযুক্তিবান্ধব প্রেক্ষাপট কে সামনে রেখে এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ কে মাথায় রেখে বর্তমান সরকার ক্যাশলেস সোসাইটি বিনির্মাণে বদ্ধ পরিকর। এই সোসাইটির তৈরীর জন্য যে ধরনের ইকো সিস্টেম তৈরী করা প্রয়োজন তার জন্যও এই সরকার কাজ শুরু করেছে।
ক্যাশলেস সোসাইটির ধারনা নতুন কিছু নয়। বিনিময়ের অসংখ্য পদ্ধতির মধ্যে ক্যাশলেস বিনিময় মাধ্যম বর্তমানে বেশ আলোচিত ও গ্রহনযোগ্য। আজকের পটভূমিতে নগদহীন সমাজ বলতে বোঝায় প্রকৃত ব্যাঙ্কনোট, কয়েন বা চেকের পরিবর্তে ডিজিটাল তথ্য (সাধারণত অর্থের ইলেকট্রনিক উপস্থাপনা) মাধ্যমে পরিচালিত আর্থিক লেনদেন ।মূলত ক্যাশলেস বলতে বোঝায় নগদ অর্থবিহীন লেনদেন, যেখানে ক্যাশ বা নগদ অর্থ ব্যবহার ছাড়াই লেনদেন করা হয়। নগদবিহীন লেনদেনের মধ্যে ক্রেডিট/ডেবিট কার্ড, মোবাইল অ্যাপসে পেমেন্ট, ডিজিটাল ওয়ালেট এবং অন্য যেকোনো অনলাইন পেমেন্টে করা অর্থ আদান-প্রদানও অন্তর্ভুক্ত।
বর্তমানে বাংলাদেশ বেশ কিছু সেক্টরে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। ক্যাশলেস ব্যবস্থা ব্যবহারের অনস্বীকার্য অনেক সুবিধা আছে যেমন ক্যাশলেসের ব্যবস্থার মাধ্যমে যেকোনো সময়, জায়গা থেকে সহজে ও দ্রুত লেনদেন সম্পন্ন করা যায়, ক্যাশলেস ব্যবস্থায় টাকা তৈরির খরচ কম আসে, অতিরিক্ত টাকা সঙ্গে না রাখার জন্য নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায়, আর্থিক অপরাধ সংখ্যা কমে যায়, এ ব্যবস্থায় কর ফাঁকি দেয়ার সম্ভাবনা নেই, প্রতিটি লেনদেনের রেকর্ড রাখা সম্ভব, নকল বা জাল টাকার জালিয়াতি থেকে সুরক্ষিত, হাতে ধরা টাকাপয়সার আদান-প্রদান বন্ধ হওয়ার কারণে রোগ-জীবাণুর সংক্রমণ কম থাকে এবং সর্বোপরি পরিবেশবান্ধব নগদবিহীন লেনদেন ব্যবস্থায় বিশ্বে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে সহায়তা করে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের অনেক সেবাখাত তাদের সেবাগুলোকে সহজতর করার জন্য কাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে নগদবিহীন লেনদেন পরিচালনার জন্য সকল ব্যাংকে নির্দেশনা প্রদান করেছে। স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখাকে চার ভাগে ভাগ করে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকনোমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি। এই বিবেচনায় ২০২১ থেকে ২০৪১ প্রেক্ষিত পরিকল্পনাও প্রণয়ন শুরু হয়ে গেছে, অর্থাৎ কীভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন হবে, তার একটা কাঠামো পরিকল্পনা বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই প্রণয়ন করে ফেলেছে, যা জনগণের জন্য অন্যতম আশীর্বাদ বয়ে আনবে। এরই ধারাবহিকতায় সকল বানিজ্যিক ব্যাংক ও এসকল নির্দেশনা মেনে তাদের লেনদেন কে ডিজিটালাইজড করার দিকে মনোনিবেশ করেছে। ক্যাশলেস উদ্যোগকে জনপ্রিয় ও প্রচলিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে যে, পণ্য বা সেবার মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে নগদ অর্থ, কার্ড বা চেক ব্যবহৃত হয়ে থাকে। নগদ অর্থে পরিশোধ ঝুঁকিপূর্ণ, চেকে পরিশোধ সময়সাপেক্ষ ও জটিল। অন্যদিকে কার্ড ব্যবহারের জন্য ব্যাংক বা এমএফএসগুলোকে ডিজিটাল পেমেন্ট অবকাঠামো বিনির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল বিনিয়োগ করতে হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় রাজধানীর একটি হোটেলে ইন্টারঅপারেবল ডিজিটাল ট্রানজেশন প্লাটফরম (আইডিটিপি) ‘বিনিময়’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, শতভাগ মানুষকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সেবার আওতায় নিয়ে আসার অংশ হিসেবে ক্যাশলেস সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের লক্ষ্যের কথা বলেছেন। তিনি আরো বলেছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবারও জয়লাভ করে ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের শতভাগ মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকবে এবং আমাদের সরকারের পরবর্তী মেয়াদে তারা ক্যাশলেস সমাজে বাস করবেন যা এই সবরকারের স্মার্ট বাংলাদেশের যে স্বপ্ন তা বাস্তবায়নকে আরো বেশী ত্বরান্বিত করবে।
বর্তমানে মুঠোফোনের মাধ্যমে পরিচালিত আর্থিক সেবা বা এমএফএসে এখন প্রতি মাসে লেনদেন হচ্ছে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া এটিএমে লেনদেন হয় প্রায় ২৯ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা, পয়েন্ট অব সেলসে ২ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা, ক্যাশ রিসাইক্লিং মেশিনে ৬ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা এবং ই-কমার্সে ১ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত জানুয়ারিতে এসব সেবায় লেনদেন হয়েছে ১ লাখ ৫৯৩ কোটি টাকা। দিনে দিনে এসব সেবার ব্যবহার বাড়ছে, যা আনুষ্ঠানিক লেনদেনের আকারকে আরও বড় করছে। এর আগে গত বছরের এসব সেবায় লেনদেন প্রথম বারের মতো এক লাখ ৭ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছিল। মোবইল ব্যাংকিং সেবাটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে চালু হলেও এখন শহরে বসবাসকারী নাগরিকেরাও এর বড় ব্যবহারকারী। ব্যবহার বাড়ার সাথে সাথে এই সেবা এখন শুধু টাকা পাঠানো ও গ্রহণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই বরং বিল পরিশোধ, কেনাকাটা, মোবাইল রিচার্জ, টাকা জমানো, ঋণ গ্রহণসহ নানা ধরনের লেনদেন করা যাচ্ছে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল গ্রহণের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন স্মার্ট সিটিজেন। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বর্তমানের চেয়ে ৫-১০ গুণও বাড়তে পারে। ভবিষ্যতের এ অদম্য অগ্রযাত্রায় সবাইকে শামিল হতে হলে প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি। আমাদের জনসংখ্যার বিরাট অংশ তরুণ জনশক্তি। তাদের দক্ষ ও যোগ্য করতে পারলেই নতুন প্রজন্ম পাবে নতুন এক বাংলাদেশ।
উন্নত বিশ্ব প্রযুক্তি ব্যবহারে আজ যে পর্যায়ে এসেছে, তার কাজটা শুরু হয়েছিল আজ থেকে তিন দশক আগে। তারপরও এখন দেশ যে শতভাগ প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে গেছে এমন দাবি করার সময় এখনো আসেনি। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঠিক সময়েই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তা অচিরেই বাস্তবায়িত হবে বলেই সবার বিশ্বাস। এখন শুধু প্রয়োজন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এ উদ্যোগকে সফলভাবে এগিয়ে নেওয়া। এ দেশের প্রত্যেক নাগরিকের উচিত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে কাজ করা। তাহলেই খুব দ্রুতই স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় শামিল হবে বাংলাদেশ। এর ফলস্বরূপ নির্মিত হবে ক্যাশলেস সোসাইটি। এর মাধ্যমে শত সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া স্বপ্নের এ সোনার বাংলা এগিয়ে যাবে বহুদূর।
লেখক: প্রভাষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।