দীর্ঘ স্থিতিশীল সময় পার করে ফের আমরা একটি অস্থিতিশীল সময়ে প্রবেশ করলাম। অস্বীকার করার উপায় নেই যে মূল্যস্ফীতি এমনিতেই বাড়ন্ত ছিল।এর প্রভাবে বাজারে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি জনজীবনে একধরণের দুর্ভাবনা তৈরি করেছে। অনানুষ্ঠানিক কাজে যুক্ত এবং নির্দিষ্ট কম আয়ের মানুষের জীবনচলা বেশ কষ্টের মধ্যেই ছিল।এরই মধ্যে গত ২৮ অক্টোবর (২০২৩) বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচির ফলে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হলো তার কারণে সরবরাবহ চেইনে বড় বিপর্যয়ের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ গ্রামগঞ্জ থেকে যেসমস্ত সবজি বা অন্যান্য পণ্য ঢাকা শহরে আসবে বা ঢাকা শহর থেকে সেখানে যাবে সেগুলোর সাপ্লাই সাইড বিঘ্নিত হবে।
আমরা জানি, এই সাপ্লাই সাইড যখন বিঘ্নিত হয় তখন সরবরাহ কমে গিয়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। এমনিতেই ঢিলেঢালা মুদ্রানীতির প্রেক্ষাপটে টাকার পরিমাণ বাজারে বেশি আছে। তাই চাহিদার চাপ তো আছেই।এই দুই-এ মিলে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা করছি আমরা। ইতিমধ্যে দেখতে পাচ্ছি সবজি-আলু-চালের মতো নিত্যপণ্যগুলোর দাম ক্রমেই বাড়ছে। সুতরাং হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচির জেরে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হলে জিনিসপত্রের দাম বাড়বেই। রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে আরও যেটি ঘটে তা হচ্ছে, মানুষের মনে এক ধরণের আস্থাহীনতা তৈরি হয়, যার কারণে বিনিয়োগ কমে। এ রকম অস্থির সময়ে মানুষ বিনিয়োগ করতে চায় না। নতুন করে ব্যবসা-বাণিজ্য হাতে নিয়ে নতুন ঝুঁকি নিতে চায় না।
রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু মানুষকে নিয়ে কাজ করে তাদের কিন্তু এটা খেয়াল করা উচিত, যে তাদের কর্মকাণ্ডের কারণে মানুষের আয় রোজগার কমে যাচ্ছে কি না।বিশেষ করে নগরে অনানুষ্ঠানিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। তাঁরা যদি রাস্তায় দাঁড়াতেই না পারে, তারা যদি ভ্যান নিয়ে চলাফেরা না করতে পারে, পণ্য যদি ট্রাকে করে না আসতে পারে, তাহলে এর প্রভাবে তো মানুষের আয় রোজগার কমবেই। সেইসঙ্গে অবধারিত ভাবেই বাড়বে জিনিসপত্রের দাম। সব মিলে একটি ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা যে তৈরি হবে তা বলার অপেক্ষাই রাখে না।
যারা অনানুষ্ঠানিক কাজ করেন, সেই শ্রেণিটি সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবেই। আর যাদের আয় মোটামুটি ফিক্সড তারাও ক্ষতির মুখে পড়বে।এই স্বল্প আয়ের মানুষদের আয় না বাড়লেও জিসিসপত্রের দাম তো বাড়ছে। কিন্তু স্বল্প আয়ের মানুষদের আয় তো আমরা বাড়াতে পারছি না। অথচ তাদের বেশি দামে জিনিসপত্র কিনতে হচ্ছে। বিশেষ করে তাদের কাছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি অসহনীয় হয়ে উঠেছে।রাজনৈতিক অস্থিরতায় এই খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।ইতিমধ্যে ১২% এর বেশি খাদ্য মূল্যস্ফীতির মধ্যে রয়েছি আমরা। আমার ধারণা ২৮ অক্টোবর থেকে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হলো এতে মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়বে। এর মধ্যে খাদ্যের দামই বেশি বাড়বে বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বলব, সরকারের যে সমর্থন আছে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের পদক্ষেপ হিসেবে, টিসিবি মাধ্যমে খাদ্য বিক্রি করে জনদূর্ভোগ কমানো। অনুরোধ থাকবে, টিসিবির খাদ্যপণ্য বিক্রির এই পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। ব্যক্তিখাতের উদ্যোক্তারাও তাদের কারখানায় কর্মরত শ্রমজীবি মানুষের জন্য সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে আরেকটু সদয় হতে পারেন।এর ইতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়বে। কিছুটা হলেও সাধারণের স্বস্তি নিশ্চিত করা যাবে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে, যতো ধরণের আন্দোলন তারা করতে চায় তারা করুক, সমাবেশ করতে চায় তারা করুক, কিন্তু রাস্তঘাট বন্ধ করা হবে না-এই অঙ্গীকারটি তাদের করা উচিত। হরতাল-অবরোধের যে সংস্কৃতি পুরনায় চালুর চেষ্টা চলছে, এটা তো আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। এটা আবার চালু করাতে যে সমস্যা সৃষ্টি হলো, এর প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সার্বিক ভাবে জনজীবনের সব কিছুর ওপরে পড়বে বলে ধরেই নেওয়া যায়। শিক্ষাখাতেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই সময়টায় স্কুলে স্কুলে পরীক্ষা হবার কথা। শিক্ষার্থীদের কী হবে?পরিস্থিতি এমন চললে, যারা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছেন, তারা সময় মতো টাকা ফেরত দিতে পারবেন না। এতে আরও নতুন সংকট তৈরি হবে।
আমরা জানি, বর্তমানে মূল্যস্ফীতির পর দেশের অর্থনীতিতে এখন বড় সংকট হচ্ছে ডলার সংকট। এই সময়টাতে আমরা আশা করছিলাম, সংকট কাটিয়ে একটি সুস্থিতিশীলতার দিকে যাব। প্রণোদনা বাড়ায় সবে মাত্র প্রবাসী আয় বাড়তে শুরু করেছে।আর এই সময়টাতেই শুরু হলো এই অনিশ্চয়তা।নির্বাচন বা রাজনৈতিক অস্থিরতা যদি সমঝোতার মাধ্যমে স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে গড়াতো তাহলে বাইরে থেকে রেমিটেন্স আরও বেশি আসতো। আমাদের রপ্তানি আয় আরও বাড়তো। সেইসঙ্গে বিনিয়োগও হয়তো বাড়তো। সব মিলে কর্মসংস্থানের ক্ষতি হতো না। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে এখন তো মনে হচ্ছে-এসবই আশার কথা। বাস্তবে তো বেশ চাপের মধ্যেই পড়লো দেশের অর্থনীতি।
রাজনৈতিক সংকটের প্রভাব সরাসরি অর্থনীতিতে পড়লেও এর সমাধান রাজনৈতিক ভাবেই হতে হবে। এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খুব বেশি কিছু করার নেই বলেই মনে করি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেটা করতে পারে সেটা হলো মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য আরও যে সমস্ত ব্যবস্থা আছে, বিশেষ করে মুদ্রানীতিতে কঠোর হওয়ার যে সুযোগ, সেটা তারা করতে পারে। এছাড়া একেবারে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে-যেমন কৃষি, এসএমই, কুটির শিল্পতে যে সহযোগিতা (ঋণ) তারা দেয় সেটার পরিমাণ আরও বাড়ানো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবসা-বানিজ্যে দেয় ঋনের কিস্তির সংখ্যা বাড়াতে পারে। অথবা আরেকটু নমনীয় করতে পারে। এই সময়টা আসলেই অনেক কঠিন, যেসব জায়গাতে প্রাকৃতিক দূর্যোগ ঘটেছে, সেসব জায়গায় সরকার অবশ্যই আলাদা উদ্যোগ নিয়েছে, এটা হয়তো আরও নিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও এসব জায়গার ব্যাংকিং ব্যবস্হায় নমনীয়তার জন্য নীতিপরামর্শ দিতে হতে পারে।কিন্তু সমস্যা হবে এসব জায়গাতেও যদি সার পাঠাতে চায় সরকার পাঠাবে কি করে যদি অবরোধ থাকে? তবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিশ্চয় বাড়তি সামাজিক সুরক্ষা সরকার দিতেই পারে।সে জন্য আমার মনে হয় রাজনৈতিক আন্দোলন চলুক কিন্তু অর্থনীতির পায়ে কোনো বেড়ি দেওয়া উচিত হবে না।
রাজনৈতিক দলগুলোতে যারা অর্থনীতি জানেন-বোঝেন তারা যে সংকটটি আঁচ করতে পারছেন না তা কিন্তু নয়। তারা ঠিকই বোঝেন কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য হলো কেবলমাত্র রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন। সেটা অর্জন করতে গিয়ে তারা মানুষের জন্য কি দূর্ভোগ সৃষ্টি করেন তা এতোটা আমলে নেন না। সেটার জন্য সমস্যা যারা মোকাবেলা করেন সেই সাধারণ মানুষেরা তখন সেই রাজনৈতিক দল থেকে নীরবে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এজন্য আমাদের মনে হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর খেয়াল করা উচিত তাদের কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ কিভাবে আহত হয়, কিভাবে তাদের আয় রোজগার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওইদিকে তাদের অবশ্যই নজর রাখা উচিত।
আমরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখছি, রিজার্ভ সংকট নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। আমার মনে হয় এনিয়ে এতো ভাবার দরকার নেই। এটা বাংলাদেশ ব্যাংক ভাববে। তবে যতোটা বলা হয় ততোটা খারাপ অবস্থায় নেই বাংলাদেশ। এটা দুশ্চিন্তার বিষয় হলেও খুব বেশি আতঙ্কের বিষয় নয়। কারণ রিজার্ভ তো সব সময় লাগে না। এটা যখন লাগে তখন ব্যবহার করতে হয়। এটা ‘রেইনি ডেইজের’ বিষয়, ‘শাইনি ডেইজের’ বিষয় নয়। তবুও দুশ্চিন্তা তো কিছু হয়-ই। প্রতি মুহূর্তে রপ্তানি ও প্রবাসি আয় তো কম বেশি বিদেশ থেকে আসছে।তাই এটা নিয়ে অযথা প্যানিক সৃষ্টি করার কারণ নেই। অনেকে শ্রীলঙ্কার উদাহরণ টানেন, কিন্তু আমি বলবো বাংলাদেশ সেই অবস্থায় নেই। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋনের পরিমান এখনও জিডিপির ২০ শতাংশের নীচেই। বছরে এখন দুই বিলিয়ন ডলারের মতো এই ঋণের কিস্তি ও সুদ করতে হয়।আর এর মধ্যে প্রাইভেট খাতের বিদেশি ঋণ বাবদ রয়েছে জিডিপির ৩ থেকে ৪ শতাংশ। সবমিলে জিডিপির ২০ শতাংশের মতো। এই অঞ্চলের দেশসমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে কম। সুতরাং এটা নিয়ে এখনি এতোটা দুশ্চিন্তা করবার কারণ নেই।
আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে বড় বিনিয়োগগুলোকে খুব সামনে নিয়ে যেতে পারব না, সেই সঙ্গে বাস্তবায়নও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই একধরণের স্যোশাল কন্ট্রাক্ট রাজনীতিতে হতেই হবে। আশা করছি সকল রাজনৈতিক অংশীজনই বাংলাদেশের ভালো চায়। তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। শান্তিপূর্ণ ক্ষমতার পালাবদল বা ক্ষমতার হস্তান্তর যাই বলি না কেন তা নির্বাচনের মাধ্যমেই হতে হবে।আর তা করা গেলেই অর্থনৈতিক রূপান্তর টেকসই করা সম্ভব।সবাই যেন নিশ্চিত পরিবেশে কাজ করতে পারেন সেই রকম একটি পরিবেশ তৈরি করা জরুরি।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার অনেক বড়। বাংলাদেশ ৪৭৫ বিলিয়ন ডলারের একটি অর্থনীতির দেশ, যা এখনি বিশ্বে ৩৫তম অর্থনীতি। হয়তো অচিরেই ২৫তম অর্থনীতি হয়ে যাবে। সেই অর্থনীতিতে বাজার হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই অর্থনীতির জন্য আমদানি করা পণ্যের দরকার হবে। তবে স্বদেশী শিল্পের ভূমিকা হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন।সেজন্যেও কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমাদের আমদানি করতেই হবে।সুতরাং সকলেই তো বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখবার চেষ্টা করবে। আমাদেরও বাজার খুঁজতে হয়। বর্তমানে পশ্চিমের অনেক জায়গায় আমাদের বাজার। মনে রাখতে হবে, আমরা কিন্তু অনেক দেশের চেয়ে গ্লোবালাইজড। তাই পশ্চিম ও পূর্বের সঙ্গে মিলে মিশেই আমাদের চলতে হবে। সেজন্য বাংলাদেশের প্রতি যেমন আগ্রহ আছে বাইরের দেশগুলোর, তেমনি আমাদেরও আগ্রহ আছে বাইরের দেশগুলোর প্রতি।
পশ্চিমানির্ভর তৈরি পোশাকখাত সহ সম্ভাবনাময় অন্যান্য খাত নিয়ে বৈশ্বিক সম্পর্ক উন্নয়নে আমাদের স্মার্ট ডিপ্লোমেসি গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমরা অযথা অপ্রাসঙ্গিক এমন কোন কথা যেন না বলি যাতে শুধু শুধু বিতর্ক সৃষ্টি হয়। কিংবা বাণিজ্যে প্রভাব পড়ে । তবে তাদেরও আমাদের খুব দরকার। কারণ একটি দেশে এতোগুলো বড় বড় ফ্যাক্টরি কিন্তু সব দেশে নেই। ইকোনমি অব স্কেল বলে একটা কথা আছে। সেই বিচারে আমাদের অবস্হান বেশ শক্ত। তাছাড়া আমাদের কারখানাগুলোর দ্রুত টেকসই কৌশল-নির্ভর রূপান্তর হচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের ৩০০ বেশি ফ্যাক্টরি সবুজ হয়ে গেছে। সুতরাং পশ্চিমের যে গ্রাহক আছে, তাদের আমাদের তৈরি এই টেকসই পণ্য দরকার। কম দামে তারা আমাদের থেকে পণ্যগুলো পায়। এক জায়গা থেকে তারা তা সংগ্রহ করতে পারছে। এটা কিন্তু একটি নির্ভরতার পারস্পারিক সম্পর্ক। এ সম্পর্ক মোটেও ঠুনকো নয়।
আমার মনে হয়, আমাদের সবসময়ই চেষ্টা করা উচিত, রপ্তানি ও আমদানি ঠিকঠাক রাখবার জন্য যাদের সঙ্গে আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য করি; তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা। একটি স্মার্ট বিদেশনীতি এখন আমরা অনুসরণ করছি।এটি যেন আমরা অব্যাহত রাখি। সাম্প্রতিক দশকে আমরা কিছু ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতারও মুখোমুখি হয়েছি। তবুও আমাদের বাণিজ্যিক জয়যাত্রা অব্যাহত রেখেছি। তবে হালে পরিস্থিতির দ্রুত বদল হচ্ছে। আমরা কি জানতাম রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে হঠাৎ করে হামাস ইসরায়েলে আক্রমণ করবে? তারপর ইসরায়েল গাজায় এমন অমানবিক হামলা চালাবে? এই ঘটনার পর এর প্রভাব বিশ্বরাজনীতিতে পড়ছে। এর প্রভাব অর্থনীতিতেও পড়বে ।এটাই স্বাভাবিক। তাই আমাদের খুব সাবধান থাকতে হবে। আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোন কারণ নেই। সর্বক্ষণ আমাদের বাণিজ্যিক অংশিজনদের সাথে এনগেজ থাকতে হবে। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব-কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ বঙ্গবন্ধুর এই পররাষ্ট্র নীতি সবাইকে মনে করিয়ে দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরিতা আসলেই আমাদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে। আমরা কারো সঙ্গে বৈরিতা করব না, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখব, এটা যেন মনোযোগ দিয়ে আমরা পালন করি। যারা পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে কাজ করেন তারা যেন খুব স্মার্টলি এই কথা গুলো মনে রাখেন। তবে আমাদের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থ যেন এই নীতিকৌশলের মধ্যমনি হিসেবে থাকে।এখন অব্দি আমরা এই কৌশলটি ধরে রাখতে পেরেছি।
জাতীয় নির্বাচন খুবই সন্নিকটে। আমাদের দেশের বাস্তবতার আলোকেই দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি হবে। এখনো যে অবস্থা আমাদের দেশের তাতে মনেকরি যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়নটাকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। এখানে কৃষি, রপ্তানি শিল্প, ডিজিটাল পণ্য, বিশেষ করে স্কিল ডেভেলপমেন্ট, অর্থাৎ শিক্ষা ও সবার জন্য স্বাস্থ্য; সেই সঙ্গে সবার জন্য স্বাস্থ্য বীমা ইশতেহারে প্রধান্য পাওয়া উচিত। এখন প্রায়শঃই ক্যানসার-হৃদরোগ হচ্ছে, আকষ্মিকভাবে অনেক টাকা প্রয়োজন হয়, তাই সার্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা চালু করা খুবই জরুরি।
আশা করব, এই বিষয়টি যেন সব দলের অগ্রাধিকারে থাকে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে আরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বিশেষ করে স্কিল ডেভেলপমেন্ট খুব জরুরি। অন্যদিকে, জলবায়ু অভিঘাত মোকাবেলায় অভিযোজনের দিকে জোর দিতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবেও আমাদের অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। কম সুদের যে ঋণ আমরা পাব সেগুলো নেব আমরা। এই সব বিষয়গুলো একসঙ্গে মিলে একটি অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়ন কৌশলের ওপর জোর দিতে হবে।
বিশ্বব্যবস্থার দ্রুত বদল হচ্ছে। যেসব দেশে দ্রুত পুঁজিবাদী উন্নয়ন ঘটছে সেখানে মূল্যবোধের অভাব ঘটছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৪০ লক্ষ পরিবার এখন ‘একক পরিবার’। পারিবারিক বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে। সেই প্রভাব আমাদের দেশেও পড়তে শুরু করেছে। ডিভোর্স বাড়ছে আমাদের এখানে। অর্থনৈতিক বৈষম্য তীব্র হচ্ছে। এর প্রভাব সমাজেও পড়ছে। আগে যে সামাজিক ভাবে এক রাজনৈতিক দলের পরিবারের সঙ্গে ভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক দলের পরিবারে বিবাহ হতো। আজকাল সেই বাস্তবতা আর নেই। অবশ্য এর পেছনে আদর্শিক কারণও রয়েছে। তবু বলবো সমাজে মিলেমিশে থাকার এই যে মূল্যবোধ, এটা অনেকটাই কমে গেছে। সামাজিক পুঁজির বড়ো ধরণের ক্ষয় হয়েই চলেছে।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের প্রধান মূল্যবোধের কেন্দ্রবিন্দু। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আসলে কি? মুক্তিযুদ্ধে চেতনা বলতে আমরা বুঝি, উদারনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষ, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ-নির্ভর অংশগ্রহণমূলক একটি সমাজ; যে সমাজে ভালো মানুষদের ঠাঁই হবে। আজকের দিনে হয়তো মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি আমরা কিন্তু যারা নিঃস্ব, যারা প্রান্তিক তাদের ঠেলে দূরে পাঠিয়ে দিই। সবই কথার কথা। অথচ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হতে হবে সবার, অন্তর্ভূক্তিমূলক। প্রান্তজনদের জায়গা আরও বেশি করে দিতে হবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে। গত দেড় দশকে এই লক্ষ্যে অনেকটা পথ নিশ্চয় হেঁটেছি। তবে আরও অনেক পথ আমাদের হাঁটা এখনও বাকি। আমরা যেন সেই লক্ষ্য পূরণে দ্বিধান্বিত না হই।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।