দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতোই ঘনিয়ে আসছে রাজনীতির মাঠে ততোই ‘সংলাপ’ সামনে চলে আসছে। দেশের রাজনীতির ইতিহাসে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে সংকট নিরসনের মাধ্যম হিসেবে সংলাপকে গুরুত্ব দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত কোন সংলাপই কার্যকর কোনো ফলাফল বয়ে আনতে পারেনি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে আবারও আলোচনায় আসছে সংলাপের বিষয়টি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বেশ কয়েকটি শর্ত আরোপ করে সংলাপে বসতে রাজি বিএনপি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শর্তযুক্ত কোন সংলাপে অংশগ্রহণ করবেনা দলটি। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসও শর্তহীনভাবে রাজনৈতিক দলগুলো সংলাপে বসে সংকট নিরসন করবে বলে প্রত্যশা করেছেন। কিন্তু বাস্তবায়তা কী? কোনো সংলাপ কী সফলতার মুখ দেখেছিল?
জিয়াউর রহমানের সংলাপ
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যখন টালমাটাল রাজনীতির পরিবেশ,তখন নানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদে বসেন জিয়াউর রহমান। নিজের ক্ষমতার আসনকে পাকাপোক্ত করতে এবং রাজনৈতিক পরিবেশ নিজের অনুকূলে আনতে চতুর জিয়া তার বিশেষ সহকারী বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে দিয়ে ১৯৭৬ সালের ২২ জানুয়ারি তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাদের ডেকে একটি সংলাপের আয়োজন করান। আওয়ামী লীগসহ প্রগতিশীল সকল রাজনৈতিক দল সে সংলাপকে প্রত্যাখান করেছিল ।
এরশাদের যত সংলাপ
১৯৮৪ সালের ৯ এপ্রিল বঙ্গভবনে সাত দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সাত দলের পক্ষ থেকে ৩০ দফা দাবি উত্থাপন করা হয় এরশাদের কাছে। এরশাদ দাবি না মানলে সাত দলের নেতারা সংলাপ কক্ষ ছেড়ে বের হয়ে আসেন। ১৯৮৪ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গভবনে জামায়াতের সঙ্গে সংলাপ করেন এরশাদ। ১১ এপ্রিল এরশাদ সংলাপ করেন ১৫ দলের নেতাদের সঙ্গে। সংলাপ ফলপ্রসূ না হলে ১৪ই এপ্রিল দ্বিতীয় দফা বৈঠক করেন ১৫ দলের নেতাদের সঙ্গে। আবার ১২ এপ্রিল এরশাদ বঙ্গভবনে বসে বৈঠক করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে। একই বছর ২৮ এপ্রিল আবারও বঙ্গভবনে এরশাদের সঙ্গে সংলাপ হয় ১০ দলের। কিন্তু কোনো সংলাপ ফলপ্রসু হয়নি।
১৯৮৭ সালে সব বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির অব্যাহত আন্দোলনে কোনঠাসা এরশাদ সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিলেন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি। রাজনৈতিক নেতারা প্রত্যাখ্যান করে সে আহ্বান। ওই বছরের ২৮ অক্টোবর এরশাদবিরোধী আন্দোলনের দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে একটি বৈঠক হয়েছিলো। একই বছরের ২৮ নভেম্বর স্বৈরশাসক এরশাদ আবারও সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিলেন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি। কিন্তু কোনো দলের কাছ থেকেই তেমন সাড়া মেলেনি।
নব্বই পরবর্তী সংলাপ
নব্বই পরবর্তী রাজনৈতিক ইতিহাসে চোখ রাখলে দেখা যায়, নির্বাচন এগিয়ে এলেই সামনে আসে সংলাপ প্রসঙ্গ। এসব সংলাপ কখনও হয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, কখনও নেতাদের মধ্যে। কখনো আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদেরও দেখা গেছে সংলাপের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে।
১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। তাদের ক্ষমতার শেষদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নামে প্রায় সব বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি। ১৯৯৪ সালের ৩১ আগস্ট সরকারি ও বিরোধী দলের দুই উপনেতার বৈঠক হয়। একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর সে সময়ের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয় বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের।
উদ্যোগ নেয়া হয় দুই প্রধান নেত্রীর বৈঠকের। কমনওয়েলথ মহাসচিব এনিয়াওকুর এমেকা ওই বছরের ১৩ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় এসে দেখা করেন দুই নেত্রীর সঙ্গে। এমেকা পরে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠান স্যার স্টিফেন নিনিয়ানকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক সংলাপ তত্ত্বাবধানে তার বিশেষত্ব ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে তিনি সফল হননি।
১৯৯৫ সালে আবার সংলাপের প্রস্তাব আসে সে সময়ের বিরোধীদল আওয়ামী লীগের কাছ থেকে। কিন্তু সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তখনকার সংসদ উপনেতা অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তবে সংলাপ ব্যর্থ হলেও ১৯৯৬ সালে একতরফা নির্বাচন করেও টিকতে পারেনি বিএনপি। আওয়ামী লীগসহ অন্য বিরোধীদলগুলোর আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় বিএনপি।
৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় সংলাপের আয়োজন হয়েছিল। ২০০১ সালেও নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দ্বন্দ্ব হয় আওয়ামী লীগ বিএনপির মধ্যে। সে সময় মধ্যস্থতার জন্য এসেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। তিনিও সংলাপ করেছিলেন দুই পক্ষের সঙ্গে। তার সে প্রচেষ্টাও ফলপ্রসূ হয়নি।
২০০৬ সালের অক্টোবরে সে সময়ের সরকারি দল বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া এবং বিরোধীদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল দফায় দফায় বৈঠক করেন। তিন সপ্তাহ ধরে ধারাবাহিক সংলাপে বিএনপি মহাসচিবের কাছে ২৯ দফা প্রস্তাব দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। ছয় দফা বৈঠক করেও তারা কোনো সমাধানে আসতে পারেননি।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২০১৩ সালের শেষ দিকে ঢাকায় আসেন জাতিসংঘ মহাসচিরের বিশেষদূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। ছয়দিন ঢাকায় অবস্থান করে ১০ ও ১১ ডিসেম্বর বৈঠক করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। তৃতীয় বৈঠক হয় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি নিল ওয়াকারের উপস্থিতিতে। কোনো বৈঠকই সফল হয়নি। এর আগে ওই বছরের ২৬ অক্টোবর টানটান রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়ে ফোন করেন সে সময়ের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সংলাপ
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও আনুষ্ঠানিক সংলাপ হয় দুই রাজনৈতিক জোটের মধ্যে। ২০১৮ সালের পয়লা নভেম্বর গণভবনে অনুষ্ঠিত সে সংলাপে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফন্ট্রের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বেশ কয়েকজন নেতা। আর আওয়ামী জোটের নেতৃত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৪ দলের নেতারা।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সংলাপ ইস্যু
যদিও সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত বলে মনে করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, সংলাপ হচ্ছে প্রধান হাতিয়ার। আমরা বলেছি, আমরা সবসময় সংলাপকে স্বাগত জানাই। সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত বলে আমরাও মনে করি। সংবিধান আমাদের যেভাবে কাঠামো করে দিয়েছে, সেটা অনুসারে সংলাপ করতে হবে। সংবিধান আমাদের যেভাবে কাঠামো করে দিয়েছে, সেটা অনুসারে সংলাপ করতে হবে। বুধবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিজ দপ্তরে ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুকের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
যদিও বিএনপি শুরু থেকেই ‘রাজপথেই ফয়সালা হবে’ আর আওয়ামী লীগ ‘বিএনপিকে কোন ছাড় নয়’ নীতি নিয়েই অগ্রসর হয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আলোচনা বা সংলাপ তখনই হবে, যখন নির্দলীয় সরকার মেনে নেওয়া হবে। দাবি মানার পর নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের মডেল বা রূপরেখা কী হবে, সেটি নিয়ে সংলাপ হতে পারে। এ ছাড়া সংলাপ করে কোনো লাভ নেই। তবে ২৮শে অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের দিনে ব্যাপক সহিংসতায় এক পুলিশ সদস্যসহ দুই জনের মৃত্যুর পর বিএনপি মহাসচিবসহ অনেককেই গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
আর উদ্ভূত এই পরিস্থিতির পর নির্বাচন নিয়ে সংলাপ বা সমঝোতার পরিবেশ তৈরির আর কোন সুযোগ আছে বলে মনে করেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন। তিনি বলেন, ‘২৮শে অক্টোবরে যে সহিংসতা হলো সেই বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ যা বলছে তাতে আসলে সমঝোতার চিন্তা করারই আর কোন সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। পরিস্থিতি যাই হোক বিএনপির জন্য আওয়ামী লীগের সংলাপের দরজা খোলা নেই-এটিই এখন বাস্তবতা।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, দল দুটির এমন অনড় অবস্থানের কারণে সমঝোতার সম্ভাবনা আগে থেকেই ছিলো না। তিনি বলেন, ‘তারা কেউই তাদের জায়গা থেকে কখনো একটুও সরেননি। এ অবস্থায় সংলাপ হওয়ার কথাও না। আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনের সাথে সংলাপ করার জন্য বিএনপিকে পরামর্শ দিয়েছিলো কিন্তু বিএনপি এই নির্বাচন কমিশনকেই মানছে না ‘ এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি সফল হোক আর না হোক কিংবা তাদের কর্মসূচি মানুষ গ্রহণ করুক আর না করুক- বিদ্যমান বাস্তবতায় সমঝোতার কোন পরিস্থিতিই অবশিষ্ট নেই বলেই মনে করেন তিনি।