মিসরের সুয়েজ খাল পেরিয়ে ১৯৭৩-এর আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সিনাই রণাঙ্গনে এসে পৌঁছলাম। ২০১০-এর জুনের সকালে। সিনাই মরুভূমির মধ্য দিয়ে তৈরি সড়ক পথে প্রায় ৫০ কিলোমিটার যাওয়ার পর স্থানীয় ট্যাক্সিচালক আহমদ জানালেন, ‘আরও প্রায় ১৫০ কিলোমিটার গেলেই সিনাইয়ের রাফা ক্রসিং।’ সেটিই মিসর-গাজার (ফিলিস্তিন) সীমান্ত। গাজা সীমান্ত ইঙ্গিত করে দীর্ঘদেহী আহমদ আরও বললেন, ‘ছোটবেলায় পরিবারের সঙ্গে শরণার্থী হিসেবে মিসরে এসেছিলাম। গাজা আমার জন্মভূমি’। আমাদের থেকে মাত্র ১৫০ কিলোমিটার দূরে থাকা প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিনের সুপ্রাচীন জনপদ গাজা এখন বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত জনপদ। যা ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর আক্রমণে পরিণত হয়েছে ভয়াল মৃত্যুপুরীতে। ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণে আহমদের মতো হতভাগ্য প্রায় ২৩ লাখ ফিলিস্তিনির জনপদ গাজায় এখন কেয়ামতের মতো দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। মিডিয়ায় দৃশ্যমান, এমন ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা সাম্প্রতিককালে বিরল। ইতোমধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত গাজায় প্রায় ৬ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। গাজার এই মহাদুর্যোগে, মজলুম ও বিপন্ন ফিলিস্তিনিদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজার হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলের অত্যাধুনিক সামরিক বাহিনীর কার্যকর নজরদারি প্রযুক্তি এবং চৌকশ ও দুর্র্ধর্ষ গোয়েন্দা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে গাজা সীমান্ত অতিক্রম করে ইসরায়েলের ভিতরে আক্রমণ করে। তাদের হামলায় ২৯৯ জন সামরিক বাহিনীর সদস্যসহ নিহত হয় প্রায় ১৪০০ ইসরায়েলি নাগরিক। হামাসের এই আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণে মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের গাজা স্ট্রিপ নামের ক্ষুদ্র উপকূলীয় ছিটমহলটি এখন ধ্বংসস্তূপ। এই বর্বর আক্রমণে সেখানে শুরু হয়েছে দ্বিতীয় নাকবা বা মহাদুর্যোগ। বৃষ্টির মতো বোমা পড়ছে হাসপাতাল, ঘরবাড়ি, স্কুল-মসজিদে। বিশেষত গাজার আল-আহালি আল-আরাবি হাসপাতালের হত্যাযজ্ঞ স্তম্ভিত করেছে বিশ্বকে। গাজার মানুষকে ‘কালেকটিভ পানিশমেন্ট’ দেওয়ার জন্য খাদ্য, বিদ্যুৎ, পানি, জ্বালানি বন্ধ করে দিয়ে গাজাকে নয়া কারবালা বানিয়েছে ইসরায়েল। প্রায় ১১ লাখ ফিলিস্তিনিকে উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণ গাজায় যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় পলায়মান মানুষের ওপর বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। ইসরায়েলের এই জঘন্য গণহত্যা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সংকটের জন্ম দিয়েছে। গাজা উপত্যকা নিয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পরিকল্পনাকে নাৎসিদের ইহুদি নিধনের সঙ্গে তুলনা করেছেন ইসরায়েলি সংসদ সদস্য ওফার ক্যাসিফ। প্যালেস্টাইনের ভবিষ্যৎ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ কথা (১৯৩০)। আশ্চর্য বিষয় হলো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩০ সালে অর্থাৎ ৯৩ বছর আগে প্যালেস্টাইন অঞ্চলে অস্থিরতা ও অশান্তির আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। জুইশ স্ট্যান্ডার্ড নামে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পত্রিকা থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক সাক্ষাৎকার যখন বের হয়, তখন (১৯৩০) প্যালেস্টাইনে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে অস্থিরতা চলছে। তখনো ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হয়নি।
সেই সময়ে ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র থেকে দলে দলে আসা ইহুদি জনগোষ্ঠী ফিলিস্তিনের আরব সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে বসবাস স্থাপন করছিল। ইহুদিরা দরিদ্র আরব সম্প্রদায় থেকে কৌশলে জমি কিনছিল। অন্যদিকে সেই সময় শক্তিশালী কিছু দেশের সমর্থনে গোপনে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা চলছিল। সেই পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘জায়নবাদী নেতৃত্বে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে আরবদের থেকে আলাদা করার জন্য জোর দিলে পবিত্র ভূমিতে বিস্ফোরণ ঘটবে।’ প্যালেস্টাইন বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ ও ভবিষ্যৎমুখী দৃষ্টি সত্যি বিস্ময়কর। বিষয়টি হয়তো এখনো প্রাসঙ্গিক।
ফিলিস্তিনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই ফিলিস্তিন ও বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ এবং আন্তরিক। ‘দুই রাষ্ট্র সমাধানের’ ভিত্তিতে বাংলাদেশ সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র সমর্থন করে এবং ইসরায়েলের ‘অবৈধভাবে ফিলিস্তিন দখলের’ সমাপ্তি দাবি করে থাকে।
প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার দূরের ফিলিস্তিনের প্রতি অব্যাহত সমর্থন জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানানোর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ গত ৫২ বছরে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি। ১৯৭১-এর পরে প্রথমদিকে অধিকাংশ আরব রাষ্ট্র সদ্যস্বাধীন হওয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, কিন্তু এই সম্পর্ক উষ্ণ হতে থাকে যখন ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে আরবদের সমর্থন করে মেডিকেল টিম ও ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সহায়তা করে।
১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে ওআইসির দ্বিতীয় সম্মেলনের সময় ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বৈঠকের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে প্রথম উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকায় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) কার্যালয় স্থাপনের অনুমতি প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও পিএলওর মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। ইসরায়েলের দখলদারির অবসান ঘটিয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা অর্জনকে সমর্থন করা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। ১৯৬৭ সালে নির্ধারিত সীমানা অনুযায়ী জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে সমর্থন করে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের চতুর্থ ন্যাম সম্মেলনে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তাঁর প্রথম ভাষণে এবং ১৯৭৪ সালে ওআইসির দ্বিতীয় সম্মেলনে ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রাম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান। বাংলাদেশে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসেফ এস ওয়াই রামাদান বলেছেন, ফিলিস্তিনের প্রতি বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের যে আন্তরিকতা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা, তা বিশ্বে বিরল। ফিলিস্তিনের সঙ্গে বাংলাদেশের ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক কেবল ধর্মের ভিত্তিতে নয়। এর সঙ্গে রয়েছে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত একটি জাতির জন্য বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের আবেগ, মমত্ববোধ ও মানবতা। ফিলিস্তিনের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের অসাধারণ আন্তরিক সমর্থন রয়েছে। ইয়াসির আরাফাত বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সফরে আসেন। প্রতিবারই তিনি বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যম, রাজনীতিবিদ ও সাধারণ জনগণের থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা পান। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সফর করেন।
১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ঘোষণার পর থেকে জাতিসংঘের যে ১৩৮টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ একটি স্মারক ডাকটিকিট উন্মোচন করে যেখানে একজন ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাকে দেখা যায়, যার পেছনে রয়েছে কাঁটাতারে ঘেরা আল-আকসা মসজিদ। সিরিয়ার রণাঙ্গনে বাংলাদেশ মেডিকেল টিম (১৯৭৩)। ইসরায়েল অধিকৃত ভূমি উদ্ধারের জন্য ১৯৭৩ সালে মিসর ও সিরিয়া যৌথভাবে ৬ অক্টোবর ১৯৭৩ তারিখে ইসরায়েল আক্রমণ করে, যা ইতিহাসে ‘আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ অক্টোবর ১৯৭৩’ নামে খ্যাত।
মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অধিকাংশ আরব দেশ তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। এ সময় এক বিস্ময়কর কূটনৈতিক অভিযানে অবতীর্ণ হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আরবদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে ঘোষণা করলেন, ‘আরবরা আমাদের স্বীকৃতি দিক না দিক, তারা আমাদের ভাই। তাদের ন্যায্য সংগ্রামে আমরা তাদের পাশে আছি।’ এই পটভূমিতেই সিরিয়ার রণাঙ্গনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি মেডিকেল টিম ও মিসরের বাহিনীর জন্য চা পাঠানো হয়েছিল। কর্নেল খুরশিদ উদ্দিন আহমেদের (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, প্রয়াত) নেতৃত্বে ২৮ সদস্যের একটি মেডিকেল টিম ১৯৭৩-এর ১৯ অক্টোবর সিরিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়। সৈন্যবাহী বিমানটির যাত্রাবিরতি হলো বাহরাইনে। এরপর বিমানটি তুরস্ক-গ্রিস মাল্টার আকাশ হয়ে অবশেষে সন্ধ্যায় ল্যান্ড করল লিবিয়ার বেনগাজি বিমানবন্দরে। বেনগাজিতে মিসরের প্রতিনিধির কাছে মিসরীয় বাহিনীর জন্য বাংলাদেশের চায়ের প্যাকেটগুলো হস্তান্তর করা হলো। ২১ অক্টোবর, লিবিয়া সরকারের বন্দোবস্তে বাংলাদেশের সেনাদল মিডল ইস্ট এয়ারলাইনসের একটি বিমানে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে পৌঁছে। বৈরুত থেকে সড়কপথে ২২ অক্টোবর ভোররাতে দামেস্ক নগরীতে পৌঁছায় মেডিকেল টিম। বাংলাদেশের মেডিকেল টিমটি দামেস্ক নগরীর পশ্চিমদিকে দারুস সালাম নামক স্থানে মোতায়েন করা হয়। সেখানে মেয়েদের একটি স্কুলে ইতিপূর্বে সিরিয়ার চিকিৎসকরা একটি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ওই চিকিৎসা কেন্দ্রটিকে বাংলার মেডিকেল দল একটি ক্ষুদ্র তবে কার্যকর ফিল্ড হাসপাতালে পরিণত করে। ওই হাসপাতালে মূলত সিরিয়ার আধাসরকারি বাহিনী ও প্যালেস্টাইনি যোদ্ধাদের চিকিৎসা দেওয়া হতো।
বাংলাদেশের সেনা দল ২২ নভেম্বর পর্যন্ত (৩০ দিন) দামেস্কে দায়িত্ব পালন করে। মেডিকেল টিমটি এক মাসে ওয়ার সার্জারিসহ শতাধিক ব্যক্তির চিকিৎসা প্রদান করে। মেডিকেল টিমের সদস্যরা তাদের পেশাগত দক্ষতা, দেশপ্রেম, আন্তরিকতা ও মমত্ব সহকারে অসুস্থ ও আহত আরবদের সেবা প্রদান করেছিল। ৩০ দিনের এই মেডিকেল মিশনটি ছিল ঘটনাবহুল ও নাটকীয়তায় ভরা। এর তাৎপর্যও ছিল ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। ১৯৭৩-এর আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু সরকার আরব ভাইদের মুক্তিসংগ্রামে সহায়তার জন্য একদল মুক্তিযোদ্ধা পাঠানোর ঘোষণা দেন। সে ঘোষণায় অনুপ্রাণিত হয় দেশের অনেক মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল এম এ তাহের, বীরউত্তম, সেখানে যুদ্ধে যোগ দিতে চেয়ে বঙ্গবন্ধুকে ১৩ অক্টোবর ১৯৭৩ তারিখে একটি চিঠি লিখেছিলেন। উল্লেখ্য, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহের তখন বিআইডব্লিউটিসির ‘সি-ট্রাক ইউনিটের’ ম্যানেজার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
লেবাননে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিম (১৯৮১)। ইসরায়েল বাহিনী ১৯৮১ সালে লেবাননে অবস্থিত ফিলিস্তিন শরণার্থীদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ পরিচালনা করেছিল। আক্রমণে হতাহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা প্রদানের জন্য ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানায়। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ সরকার লেবাননে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি মেডিকেল টিম লেবাননে পাঠায়। তৎকালীন লে. কর্নেল এইচ কে এম গোলাম মুরতোজার (পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) নেতৃত্বে ৬ সদস্যের এই মেডিকেল টিম ১৯৮১ সালের ২৩ আগস্ট লেবাননে যায়। দায়িত্ব পালন শেষে দলটি ১৯৮১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে। মেডিকেল টিমটি দক্ষিণ লেবাননের সিডনে অবস্থিত সাইদা হাসপাতালে আহত ফিলিস্তিনিদের চিকিৎসা প্রদান করে। সিডন ছাড়াও এই মেডিকেল টিম ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি পরিচালিত কয়েকটি হাসপাতালে যায়। লেবাননে ফিলিস্তিনির পক্ষে বাংলাদেশিদের যুদ্ধ (১৯৮০-১৯৮২)। ইয়াসির আরাফাত যখন ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন আবাসভূমি গড়ার সংগ্রামে লিপ্ত তখন সেই সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন অনেক বাংলাদেশি তরুণ। ১৯৮০-৮২ সালে লেবাননে অবস্থান নিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল কয়েক শ মতান্তরে কয়েক হাজার বাংলদেশি তরুণ। ১৯৭০-১৯৮০ দশকে লেবাননে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) সদর দফতরসহ (বৈরুতে) শক্তিশালী অবস্থান ছিল। ১৯৮২-এর জুনে ইসরায়েল লেবাননে আগ্রাসন পরিচালনা করলে ফিলিস্তিনি গেরিলাদের সঙ্গে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধারা লেবাননে প্যালেস্টানিদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন। চরম গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের সঙ্গে অস্ত্র হাতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করা থেকে শুরু করে অস্ত্র-রসদ বহন ও পাহারার কাজও করেছেন বাংলাদেশের এসব তরুণ স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধা। জানা যায়, লেবাননের প্রায় শতাধিক বাংলাদেশি যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রায় ৮ হাজার বাংলাদেশি অংশ নিয়েছেন। উল্লেখ্য, লেবাননের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের বড় অংশ ছিল বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের সদস্য। বিশেষত তারুণ্যনির্ভর একটি বামপন্থি দলের। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধে লেবাননে সম্মুখ সারির গেরিলা ছিলেন নরসিংদীর আতাউর রহমান ফারুক। তিনি নিজের যুদ্ধ-অভিজ্ঞতার রোমাঞ্চকর ঘটনা নিয়ে ‘ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের গেরিলা আমি’-নামে একটি বই লিখেছেন।
লেবাননের যুদ্ধে বাংলাদেশি যোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। পিএলও লেবানন শাখার সূত্রমতে, বাংলাদেশি যোদ্ধাদের সংখ্যা ১ থেকে দেড় হাজার হতে পারে (দৈনিক আল-আখবার)। সাম্প্রতিক ঘটনা ও বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া। ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশ তার সৃষ্টির সময় থেকেই ফিলিস্তিনের নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের পাশে আছে এবং তাদের সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছে। ইসরায়েলের চলমান নৃশংস মানবতাবিরোধী এই হামলায় নারী, শিশু ও সাধারণ ফিলিস্তিনিরা মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে।
সাম্প্রতিক গাজাবাসীর ওপর ইসরায়েলের নির্লজ্জ হামলার নিন্দা জানিয়ে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে চিঠি পাঠিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে তিনি ফিলিস্তিনের প্রতি বাংলাদেশ ও এর জনগণের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশ সব সময় ফিলিস্তিনের পাশে আছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে ওআইসিভুক্ত ১৪ দেশের রাষ্ট্রদূত সাক্ষাৎ করতে এলে এসব কথা বলেন তিনি। ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ রামাদানের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ সব সময় ফিলিস্তিনের পক্ষে আছে। ২০ অক্টোবর শুক্রবার বাংলাদেশের সব মসজিদে ফিলিস্তিনিদের জন্য দোয়া পড়ানো হয়। ২১ অক্টোবর গাজার নিহত ফিলিস্তিনিদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক প্রকাশ করা হয়েছে। ২২ অক্টোবর ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের জন্য জাতীয় সংসদে শোক জানানো হয়। গাজা উপত্যকার যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের জন্য মানবিক সহায়তা চালানের প্রথম কিস্তি ২৩ অক্টোবর বিকালে ঢাকায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্রদূতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যুদ্ধ বন্ধ করা। বিপন্ন ফিলিস্তিনিদের জীবন রক্ষা করা। যুদ্ধবিরতির কথা বারবার বলছে বাংলাদেশ। ইসরায়েলের এই বর্বর আক্রমণ বন্ধ করতে এগিয়ে আসুক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক।